আবুল হুসেন সংক্ষিপ্ত জীবনী |
আবুল হুসেনের জন্ম ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি (বাংলা ১৩০৩ সালের ২৩ পৌষ) বুধবার যশোর জেলায় পানিসারা গ্রামে মাতুলালয়ে। তাঁর পিত্রালয় যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার কাউরিয়া গ্রামে। তাঁর পিতা মুহম্মদ মুসা তাঁর এলাকায় খ্যাতিমান আলেম ছিলেন। তাঁর প্রণীত 'নামাজ শিক্ষা' পুস্তকটি জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। আবুল হুসেনের মায়ের নাম আসিরুন নেসা খাতুন। আবুল হুসেনের পিতামহ মুহম্মদ হাশিম ছিলেন একজন বিবেকবান, যুক্তিপরায়ণ, জ্ঞানানুরাগী, কুসংস্কারবিরোধী যশস্বী পুরুষ। পিতামহের সমাজসংস্কার-প্রবণতা এবং পিতা ও পিতামহের জ্ঞানানুরাগ ও চরিত্রবল আবুল হুসেনের জীবনে প্রবলতর হয়েছিল।
আবুল হুসেন কৃতী ছাত্র ছিলেন। তিনি প্রথমে ঝিকরগাছা এম, ই স্কুলে ও পরে যশোর জিলা স্কুলে শিক্ষা লাভ করেন, এবং শেষোক্ত স্কুল থেকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে সরকারি বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়ন করেন এবং উক্ত কলেজ থেকে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে আই এ. এবং ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে বি.এ. পাশ করেন। উভয় পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম বিভাগ ও সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম. এ. পাশ করেন। স্কুলে, কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি রচনা-প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কার লাভ করেছেন। কলকাতায় অধ্যয়নকালে তিনি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে সভা-সমিতিতে পাঠ করেছেন এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন।
যশোর জিলা স্কুলে আবুল হুসেনের প্রিয় শিক্ষক ছিলেন কাজী আনোয়ারুল কাদীর। কাজী আনোয়ারুল কাদীর ছিলেন সন্ধিৎসু, বিচারপ্রবণ ও সৃষ্টিশীল মনের অধিকারী, প্রভাবশালী শিক্ষক। সমাজসংস্কার বিষয়ক চিন্তামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি। তাঁর রচিত আমাদের দুঃখ গ্রন্থটিতে তৎকালীন বাঙালি মুসলমান সমাজের কয়েকটি গুরুতর সমস্যা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। কাজী আনোয়ারুল কাদীরের চিন্তা ও সমাজসংস্কার- প্রবণতা আবুল হুসেনের চিন্তাশক্তিকে উদ্দীপ্ত করেছিল। পরবর্তীকালে ঢাকার বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে কাজী আনোয়ারুল কাদীর আবুল হুসেনের সহযাত্রী ও সহকর্মী ছিলেন।
এম. এ. পরীক্ষা দিয়েই আবুল হুসেন কলকাতার হেয়ার স্কুলে সহকারী শিক্ষকের পদে যোগদান করেন। মাসিক বেতন ৫০ টাকা। গোটা সংসারের দায়িত্ব তখনই তাঁকে গ্রহণ করতে হয়। তখন সাংসারিক ব্যয় নির্বাহের জন্য তাঁকে কয়েকটি টিউশনি করতে হয়েছে। ব্যবহারজীবীর স্বাধীন পেশা গ্রহণের উদ্দেশ্যে তিনি ল' কলেজে ভর্তি হয়ে আইন অধ্যয়ন আরম্ভ করেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে সাতক্ষিরার সুলতানপুর নিবাসী শেখ বশিরউদ্দিনের কন্যা মোসাম্মাৎ মৌলুদা খাতুনের সঙ্গে আবুল হুসেনের বিয়ে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরেই তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ওও বাণিজ্য বিভাগে সহকারী লেকচারার পদে যোগদান করেন। মাসিক বেতন ১২৫ টাকা। এই বিভাগে তিনি ছয় বছর অধ্যাপনা করেন। লেকচারার পদে উন্নীত হওয়ার পর তাঁর বেতন বৃদ্ধি পেয়ে ৫৭৫ টাকায় পৌঁছেছিল। তখন তিনি মুসলিম হলের (বর্তমান সলিমুল্লাহ হল) হাউজ টিউটরের দায়িত্বও পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত থাকাকালে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বি.এল, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
আবুল হুসেন |
আবুল হুসেনের লেখা 'শতকরা পঁয়তাল্লিশ' শীর্ষক প্রবন্ধ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে প্রকাশিত কবি গোলাম মোস্তফার বক্তব্যের সবিনয় প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকুরি ত্যাগ করে ঢাকা জজকোর্টে আইন ব্যবসায়ের অনিশ্চিত পেশায় যোগদান করেন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় বারের চেষ্টায় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম, এল, (মাস্টার অব ল') ডিগ্রী লাভ করেন। বাঙালি মুসলমানদের মধো তিনিই প্রথম এই ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা হাইকোর্ট বারে যোগদান করেন। হাইকোর্ট বারে যোগদান করার পর তিনি কঠোর পরিশ্রম করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য The History of Development of Muslim Law in British India বিষয়ে Tagore Law Lecture প্রণয়ন করেরছিলেন।
আবুল হুসেনের ঢাকা ত্যাগের পর শিখার প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায় এবং মুসলিম সাহিত্য-সমাজের কর্মধারা নিষ্প্রভ হয়ে পড়তে থাকে। আরও আগেই আবুল হুসেন মুসলিম সাহিত্য-সমাজের সম্পাদকের পদ ত্যাগ করেছিলেন। কবি আবদুল কাদির উল্লেখ করেছেন: “তখনও আবুল হুসেনেরই তত্ত্বাবধানে ও অর্থানুকূল্যে 'শিখা' প্রকাশিত হয়।" তিনি আরও উল্লেখ করেছেন: "সাহিত্য-সমাজে প্রথম থেকেই নরমপন্থী লেখকরাও স্থান পেয়েছিলেন।....আবুল হুসেনের কর্ণধারত্ব ত্যাগের পর সাহিত্য-সমাজ চিন্তার ক্ষেত্রে প্রধানত গ্রহণ করে নরমপন্থা...।"কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে আবুল হুসেন জীবনযাপন করেছেন। বিরাট সংসারের ভরণ- পোষণের দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। 'মুসলিম সাহিত্য-সমাজ', 'আল মামুন ক্লাব', অ্যান্টি-পর্দা লীগ প্রভৃতি সংগঠনের কেন্দ্রীয় দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন-বিভিন্ন কর্মসূচিতে নিয়মিত অর্থসংস্থানও করেছেন। মাসিক 'তরুণপত্র', মাসিক 'অভিযান', মাসিক 'জাগরণ', বার্ষিক 'শিখা' প্রভৃতি পত্রিকার অর্থসংস্থান, সম্পাদনা, ও মুদ্রণ ইত্যাদি নানাবিধ কাজে তিনি যুক্ত থেকেছেন, এবং আগ্রহের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। মুসলিম সাহিত্য- সমাজ ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মূল সংগঠক ছিলেন তিনি। এই ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি লেখায় নিবিষ্ট থেকেছেন। স্কুলের অনেকগুলো পাঠ্যপুস্তকও রচনা করেছেন। এইসব কাজে যে শ্রম তিনি দিয়েছেন, তা সকলকে বিস্মিত ও মুগ্ধ করেছে। মনে হয়, মোমবাতি দুদিক দিয়ে জ্বালানোর মতো করে তিনি তাঁর জীবনীশক্তি ব্যয় করেছেন। ক্রমে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়তে থাকে।
তিনি চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। অনেক চিকিৎসার পর তাঁর পাকস্থলীর অস্ত্রে দুরারোগ্য ক্যান্সার ধরা পড়ে। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ অক্টোবর শনিবার সকাল সাড়ে সাতটায় মাত্র ৪১ বৎসর ৯ মাস বয়সে তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। ওইদিন কলকাতা পার্ক সার্কাস ময়দানে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতা থেকে ট্রেনে তাঁর লাশ এনে রাত আড়াইটায় যশোর জেলার পানিসারা গ্রামে তাঁর পিতার কবরের পাশে কবর দেওয়া হয়।
ঢাকার 'মুসলিম সাহিত্য-সমাজ' ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন সম্পর্কে, সেই সঙ্গে আবুল হুসেন সম্পর্কে, ১৯২০-এর দশক থেকে আজ পর্যন্ত অনেক লেখা হয়েছে, এবং নিঃসংশয়ে আশা করা যায়, ভবিষ্যতেও অনেক লেখা হবে। এই সময়ের মধ্যে অনেক ভাবুক ও কর্মী অনুপ্রাণিত হয়েছেন আবুল হুসেন ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের চিন্তা ও কর্মের দ্বারা। অপরদিকে, রক্ষণশীলেরা আজও বিরূপ মনোভাবের পরিচয় দেন তাঁদের চিন্তা ও কর্মের মুখোমুখী হয়ে। বহু গবেষক ও ভাবুক দুষ্প্রাপ্য তথ্য সংগ্রহ করেছেন তাঁদের সম্পর্কে,- নানাভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও মূল্যবিচার করেছেন তাঁদের চিন্তা ও কর্মের। তবু আরও অনুসন্ধান ও চিন্তার প্রয়োজন থেকে যায়, এবং নতুন অনুসন্ধান ও নতুন করে চিন্তা করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এ অবস্থায়, সংক্ষিপ্ত পরিসরে আবুল হুসেনের চিন্তা ও কর্মের পরিচয় তুলে ধরা সম্ভবপর নয়।
আবুল হুসেনের 'শতকরা পঁয়তাল্লিশ', 'নিষেধের বিড়ম্বনা', 'আদেশের নিগ্রহ' প্রভৃতি লেখা নিয়ে তুমুল বিতর্ক ও বাদ-প্রতিবাদ হয়েছে,-শেষোক্ত লেখা দুটোর জন্য দুইবার ঢাকার নবাবদের কর্তৃত্বাধীন তৎকালীন পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় তাঁর বিচার হয়েছে। নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন তিনি এবং তাঁর সহযোগী সাধক ও কর্মীরা। এইসব ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজ এগিয়েছে। বর্তমানে আবার উল্টো হাওয়ার প্রবাহ চলছে। এ অবস্থায় এগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা দ্বারা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। বিস্তৃত পরিসরে স্বতন্ত্র আলোচনার সুযোগ অবারিত আছে এবং সে ধরনের আলোচনাই কাম্য।