আচার্য স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি রসায়নবিদ, শিক্ষক, দার্শনিক ও কবি। তিনি ১৯৬১ সালের ২ আগস্ট তৎকালীন যশোর জেলার পাইকগাছা উপজেলার (বর্তমান খুলনা জেলা) রাড়ুলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। রাড়ুলি কপোতাক্ষের কোল ঘেঁষা এক মনোরম গ্রাম। প্রফুল্লচন্দ্র তার জীবনীগ্রন্থ 'আত্মচরিত'-এ লিখেছেন-
'এই গ্রামটি কপোতাক্ষ নদী তীরে অবস্থিত। কপোতাক্ষী ৪০ মাইল আঁকাবাঁকা পথ ঘুরিয়া কবিবর মধুসূদন দত্তের জন্মস্থান সাঁগরদাড়িতে পৌঁছেছে। এই নদীরই আরও উজানে বিখ্যাত সাংবাদিক শিশিরকুমার ঘোষের জন্মস্থান পলুয়া মাগুরা - যাহা পরে 'অমৃতবাজার' নামে পরিচিত হইয়াছে'
প্রফুল্ল চন্দ্র মার্কারি (I) নাইট্রেট (মারকিউরাস নাইট্রাইট) [Hg2(NO2)2] আবিষ্কার সহ মোট ১২টি যৌগিক লবণ এবং ৫টি থায়োএস্টার আবিষ্কারের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত। দেশি শিল্পায়ন উদ্যোক্তাও ছিলেন তিনি। শিক্ষকতার জন্য তিনি ‘আচার্য’ হিসেবে আখ্যায়িত হন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ সরকারের থেকে নাইট উপাধি লাভ করেন। তার বিচিত্র কর্মময় জীবন ও সাধনা সম্পর্কে অন্যদিন জানাব। ৭৯ তম প্রয়াণ দিবস (মৃত্যু - ১৬ জুন ১৯৪৪) উপলক্ষ্যে আজ জানাব ঝিকরগাছা ও তাঁর যোগসূত্র সম্পর্কে।
আচার্য স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের পূর্বপুরুষদের বসতি ছিল ঝিকরগাছা উপজেলার হাজিরালি, বোধখানা ও গঙ্গানন্দপুর গ্রামে। প্রাক-বৃটিশ শাসনামলে বোধখানার চৌধুরী বংশ ছিল খুব বিখ্যাত। এই বংশের ধারা শুরু হয়েছিল দেব বংশের প্রথম হরিদেবের মাধ্যমে। দেব বংশের অষ্টম পুরুষ ছিলেন পীতাম্বর দেব। তিনি নবাবী আমলে সরকারের চাকরি করে ‘খাঁ’ উপাধি পান। পীতাম্বর খাঁ’র থেকে পঞ্চম পুরুষ অর্থাৎ দেব বংশের ১৩তম পুরুষ ছিলেন শিবদাস দেব সরকার। শিবদাস ভার্বতর্ষের প্রখ্যাত পুরন্দর খাঁর প্রিয় পাত্র ছিলেন। শিবদাস দেব সরকার পুরন্দর খাঁর সুপারিশে নবাবের কাজ থেকে মলুই পরগণার জমিদারি লাভ করেন। জমিদারি প্রাপ্তির পর তিনি স্বপরিবারে ঝিকরগাছা কপোতাক্ষকুলের হাজেরালি গ্রামে বসতি স্থাপন করেন।
শিবদাসের ছিল দুই সন্তান - শ্রীরাম খাঁ ও নীলাম্বর খাঁ। এই শ্রীরাম খাঁ-ই মূলত বোধখানার চৌধুরী বংশের প্রবক্তা। তিনি বেশ স্বাধীন চেতনার অধিকারী ছিলেন। কথিত আছে গাজী-কালুর সাথে শ্রীরাম খাঁ-র ছিল বিরোধ। সেই বিরোধের জেরেই গাজীর মাধ্যমে তিনি স্বপরিবারে নিহত হন। এক বিশ্বস্ত দাসীর কল্যাণে শুধু প্রাণে রক্ষা পান শ্রীরাম খাঁর শিশুপুত্র অজিতনারায়ণ। এই অজিতনারায়ণের ছেলে রাজা কমলনারায়ণ রায়ের উত্তরসূরি রাজা কংসনারায়ণ পরবর্তীতে গঙ্গানন্দপুরে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
এই ঘটনার পর ভীত হয়ে শ্রীরাম খাঁ-র ভাই নীলাম্বর খাঁ স্বপরিবারে হাজেরালি ত্যাগ করে তৎকালীন খুলনার হরিঢালীতে বসবাস শুরু করেন। তারপর বহু চড়াই উতরাই পেরিয়ে চৌধুরী বিংশের এই ধারাটি একদা তৎকালীন যশোর জেলার রাড়ুলি (বর্তমান খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলাধীন) গ্রামে কপোতাক্ষ কুলে বসতি স্থাপন করেন। এই নীলাম্বর খাঁর থেকে দশম পুরুষ মহামতি হরিশচন্দ্রের তৃতীয় সন্তান ছিলেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্জ স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।
রাড়ুলিতে প্রফুল্লচন্দ্রের পৈতৃক বাড়ি। ছবি : wikimedia commons. |
ইতিহাসবিদ সতীশচন্দ্র মিত্র বোধখানার চৌধুরী বংশের বর্ণনা দিতে গিয়ে এক স্থানে বলেছেন,
“মহামতি হরিশ্চন্দ্রের তৃতীয় পুত্র বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক সার প্ররচন্দ্র রায় (Sir P. C. Ray. K1.. C.IE., D.SC., PH.D., F.C.S. &c.)। যে সকল ভাগ্যবান ব্যক্তির জীবদ্দশায়ই তাঁহাদের জীবনী বাহির হয়, তিনি তাহার অন্যতম; অনেকেই তাঁহার প্রধান প্রধান আবিষ্কার ও অবদানের কথা জানেন। তিনি জ্ঞানবিজ্ঞানে পণ্ডিতগণ্য আচার্য; সংসার ধর্মে বিলাস-বিরহিত ঋধিকল্পে চিরকুমার, দেশের ও দশের সেবায় একাগ্রকর্মী দানবীর; তাঁহার পরিচয় আমি কি দিব? যশোহর- খুলনায় এমন শিক্ষিত ব্যক্তি কেহ নাই, যিনি খুলনা জেলার এই কৃতী সন্তানের এবং দেশের এই একনিষ্ঠ সেবকের দানের কথা, ধ্যানের কথা, কর্মের কথা ও মর্গের কথা না শুনিয়াছেন। এই পুস্তকের জন্য আমি তাঁহার নিকট ঋণী বলিলে ঠিক হয় না; এই পুস্তকই তাহার, আমি উপলক্ষ্য মাত্র। অনেক স্থানে রাজার দানে পুস্তক প্রকাশিত হয়, কিন্তু রাজার প্রাণ তাহার মধ্যে থাকে না। বর্তমান ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি আমাকে জাগাইয়া কার্যব্রতী করিয়াছিলেন, তাঁহারই অযাচিত অনুকম্পায়, তাঁহারই প্রাণের মহিমায় গত দেশের পুরাতত্ত্বের আলোচনার কঠোর সাধনায় একাগ্রভাবে আত্মসমর্পণ করিয়া জীবনের বেলা সংক্ষেপ করিয়া আনিয়াছি। প্রকৃতচন্দ্র নিজের অপার্থিব চরিত্রে, অসামান্য প্রতিভায় এবং অপরিসীম ত্যাগ-মাহাত্ম্যে তাঁহার দেশ, তাহার স্বজাতি এবং তাঁহার প্রসিদ্ধ বংশকে সমুজ্জ্বল করিয়াছেন।”
২
১৯০৩ সালের কোলকাতা নৌ বন্দরের একটি ছবি |
ঝিকরগাছায় প্রফুল্ল চন্দ্রের স্টিমার ব্যবসা
বংশের আদি পুরুষদের সূত্রতার বাইরেও আর একটি ব্যাপারে প্রফুল্ল চন্দ্রের সাথে ঝিকরগাছার যোগসূত্র পাওয়া যায়। এটি অবশ্য ব্যবসায়িক কারণে।ব্যবসায়ের দিকে ঝোঁক ছিল তাঁর। তবে তা অপরিসীম সম্পদ লাভের আশায় নয়। বাংলার যুবকদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ও স্বদেশী শিল্প প্রসারই ছিল তার লক্ষ্য। তাই তো ইউরোপ থেকে দেশে ফিরেই দেখতে শুরু করেন দেশীয় সম্পদ আর দেশীয় শিল্প বিপ্লবের স্বপ্ন। ১৮৯২ সালে কলকাতায় মাত্র ৭০০ টাকা বিনিয়োগ করে গড়ে তুলেছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড। বর্তমান যে খুলনা টেক্সটাইল মিলস এটি তার হাতেই গড়া। এছাড়াও অসংখ্য শিল্পোদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। তারই একটি অংশ ছিল স্টিমার ব্যবসা।
তৎকালে নদীপথে স্টিমার এবং সমুদ্রপথে জাহাজ ব্যবসার দখল ছিল একচেটিয়াভাবে বিদেশিদের দখলে। ঝিকরগাছা-কোলকাতা নৌযোগাযোগের ক্ষেত্রেও ছিল একই চিত্র। বিদেশি স্টিমার কোম্পানির কুটবুদ্ধির কাছে পেরে উঠছিলো না দেশি কোম্পানিগুলো। প্রফুল্ল চন্দ্রও একটি দেশি স্টিমার কোম্পানির অংশীদার ও পরিচালক সমিতিতে ছিলেন। তাঁর একটি মাত্র স্টিমার ছিল যা কপোতাক্ষের বুকে ঝিকরগাছার ঘাট থেকে কোলকাতা অবধি চলাচল করতো। বিদেশি কোম্পানিদের সাথে অসম প্রতিযোগিতায় প্রফল্ল চন্দ্র প্রায় দুই লক্ষ টাকা লোকসান গুনেছিলেন। সে সময়ে এই রুটে চলাচলকারী অন্যান্য দেশি স্টিমার কোম্পানিদেরও একই অবস্থা তৈরি হয়েছিল। মূলত বিদেশি পুঁজিপতিদের কাঁচা টাকা আর কূটবুদ্ধির কাছেই হেরে গিয়েছিলেন তারা। জানা যায়, যে পথের ভাড়া ১ টাকা ছিল সেই ভাড়া বিদেশি কোম্পানি রাতারাতি ১/১৬ অংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বদেশি কোম্পানিগুলোর পক্ষে তা করা ছিল অসম্ভব। ফলে যাত্রী সংখ্যাও কমে গিয়েছিল একই হারে।
তথ্যসূত্র -
prafulla chandra ray scientist, prafulla chandra ray quotes, prafulla chandra roy picture, acharya prafulla chandra roy life history, prafulla chandra ray information, prafulla chandra ray history, prafulla chandra roy biography in bengali.
Search Tags : BENGALI/বাংলা
প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় স্মরণীয় কেন, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এর জীবনী, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অবদান, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বই, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় pdf, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় জীবনী, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় খুলনা জেলা, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় যশোর জেলা, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ঝিকরগাছা, হাজেরালি, বোধখানা, গঙ্গানন্দপুর, রাড়ুলি, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বিজ্ঞানী, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের বাড়ি, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় সম্পর্কে