১৭৯৪ খৃষ্টাব্দে পুনরায় সীমার পরিবর্তন হয়। তখন ঝিকারগাছার কাছে কপোতাক্ষী নদী যশোহর জেলার পশ্চিম সীমা হয়। ঝিকারগাছা হইতে বনগ্রাম যাইবার রাস্তার উত্তরাংশ নদীয়া জেলাভুক্ত হয়, কিন্তু উহার দক্ষিণাংশ অর্থাৎ কপোতাক্ষী ও ইচ্ছামতীর মধ্যবর্তী প্রদেশ যশোহরের মধ্যেই রহিয়া যায়। বহুকাল পরে ১৮৬৩ অব্দে এই দক্ষিণাংশ অর্থাৎ প্রধানতঃ সাতক্ষীরা সবডিভিসন চব্বিশ পরগণা জেলার মধ্যে যায় এবং উত্তরাংশ বা বনগ্রাম মহকুমা নদীয়া হইতে যশোহরের অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৮৪২ অব্দে খুলনাকে একটি মহকুমায় পরিণত করা হয়। ইহাই বঙ্গদেশের মধ্যে সর্ব্বপ্রথম সবডিভিসন। সম্পূর্ণ বাগেরহাট এবং যশোহর সদর ও নড়াইলের কতকাংশ ঐ সময়ে খুলনা মহকুমার শাসনাধীন হইয়াছিল।
১৮৪৫ অব্দে মাগুরা মহকুমা স্থাপিত হয়। যেখানে মুচিখালী দিয়া গড়ই ও কুমারনদের জল নবগঙ্গায় পড়িতেছিল, সেই সন্ধিস্থলে নবগঙ্গার দক্ষিণমুখী বাঁকের তীরে মাগুরা অবস্থিত। পূর্ব্বে এই নদীকূলবর্তী স্থানে মগ প্রভৃতি নানাজাতীয় দস্যুদিগের কিরূপ উপদ্রব ছিল, তাহা পূর্ব্বে বলিয়াছি (১৮শ পরিচ্ছেদ ও ৪১শ পরিচ্ছেদ)। ইংরাজ আমলে এই প্রদেশে সর্ব্বদা ডাকাইতি হইত। উহা দমন করিবার সুবিধার জন্য এই মহকুমা খোলা হয়। ককবার্ণ (Cockburn) সাহেব উহার প্রথম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট।
ঝিনেদহ (Jhenidah) বা ঝিনাইদহ নবগঙ্গার কূলে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এখন সেখানে নবগঙ্গা একপ্রকার মরিয়া গিয়াছে। সুতরাং যশোহর-ঝিনেদহ নূতন লাইট-রেলওয়ে ভিন্ন যাতায়াতের অন্য সুবিধা নাই। ওয়ারেন হেষ্টিংসের সময় হইতে এখানে ভূষণার অধীন চৌকি ছিল। ১৭৮৬ দিন পর্যন্ত মামুদশাহীর তহশীল কাছারী এখান ছিল। শেরবার্গ (Sherburne) সাহের শেষ কালেক্টর ছিলেন । ১৭৮৭ অব্দে মামুদশাহী যশোহর কালেক্টরী ভুক্ত হয়। এখনও মামুদশাহীর নয় থানা অংশের নড়াইল জমিদারদিগের কাছারী বর্ত্তমান ঝিনেদহের পার্শ্ববর্তী চাকলা নামক স্থানে রহিয়াছে। ১৭৯৩ অব্দে এখানে একটি পুলিস থানা স্থাপিত হয়। নীল বিদ্রোহের ফলে ১৮৬২ আসেন এখানে মহকুমা বুলিবার প্রয়োজন হয়।
নড়াইলেও নীল বিদ্রোহের সময়ে ১৮৬১ অব্দে মহকুমা হয়। প্রথমতঃ ফরিদপুরের অন্তর্গত গোপালগঞ্জে এই মহকুমার স্থান নির্ব্বাচিত হয়; পরে অতি অল্প সময় মধ্যে সেখান হইতে ক্রমান্বয়ে বারাসিয়া কূলে ভাটিয়াপাড়া, নবগঙ্গার কূলে লোহাগড়া ও নদীর পরপারে কুমারগঞ্জে (চণ্ডীবরপুর) এবং অবশেষে নড়াইলে মহকুমার সদর ষ্টেশন স্থাপিত হয়। ১৮৬১ অব্দে সাতক্ষীরা মহকুমা গঠিত হয় এবং দুই বৎসর পরে উহা চব্বিশ পরগণার অন্তকারী হইয়া যায়। ১৮৬৩ অব্দে বাগেরহাটও একটি মহকুমা বলিয়া চিহ্নিত হয়, এতদিন উহা খুলনারই মধ্যে ছিল। মোরেল সাহেবদিগের অত্যাচার নিবারণ করে এই ব্যবস্থার প্রয়োজন সে কথা পরে বলিব। সর্ব্বপ্রথমে বাগ অর্থাৎ বাগানের মধ্যে হাট মিলিয়াছিল বলিয়াই ইহার নাম বাগেরহাট। বাঘ বা ব্যাঘ্রের সঙ্গে এ নামের কোন সম্বন্ধ নাই।
১৮৮১-২ অব্দে বঙ্গীয় গবর্ণমেন্ট স্থির করিলেন যে, খুলনাকে কেন্দ্রস্থান করিয়া সুন্দরবনের জন্য একটি পৃথক্ জেলা গঠন করা প্রয়োজনীয়। এজন্য যশোহরের মধ্য হইতে খুলনা ও বাগেরহাট মহকুমান্বয় এবং ২৪-পরগণার মধ্য হইতে সাতক্ষীরা মহকুমা লইয়া খুলনাকে একটি নূতন জেলায় পরিণত করা হয়। ১৮১৬ খৃষ্টাব্দ হইতে সুন্দরবনের শাসন জন্য রেভেনিউ বোর্ডের অধীন একজন পৃথক্ কমিশনার ছিলেন। ১৯০৫ অদক্ষ হইতে সুন্দরবনের কর্তৃত্বভার সংশ্লিষ্ট তিনটি (২৪-পরগণা, খুলনা ও বাখরগঞ্জ) জেলার কালেক্টরগণের উপর পড়িয়াছে।
তাহা হইলে দেখা গেল, এক্ষণে যশোহর জেলায় সদর মহকুমার সঙ্গে নড়াইল, মাগুরা, ঝিনেদহ ও বনগ্রাম লইয়া মোট পাঁচটি মহকুমা। সমগ্র জেরার পরিমাণ ফল ২,৯০৪ বর্গমাইল এবং ১৯২১ অব্দের গণনানুসারে লোকসংখ্যা ১৭,২২,২১৯ জন। খুলনা জেলায় সদর, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা এই তিনটি মহকুমা। পরিমাণফল ৪,৭৩০ বর্গমাইল, তন্মধ্যে সুন্দরবনেরই পরিমাণ ২২৯৭ বর্গমাইল। ১৯২১ অব্দের সমাহার (Census) অনুসারে লোকসংখ্যা ১৪,৫৩,০৩৪ জন। উভয় জেলার পরিমাণফল ৭,৬৩৪ বর্গমাইল এবং লোকসমষ্টি ৩১, ৭৫, ২৫৩ জন।
হেঙ্কেল সাহেবের সময় মুড়লীতে যশোহর জেলার সদর ষ্টেশন ছিল; ১৭৮৯ অব্দে তিনি বদলী হইবার পর, যখন রোক সাহেব (Richard Rocke) কালেক্টর হন, তখন তিনি কি কারণে ঠিক জানা যায় না, মুড়লী ত্যাগ করিয়া পার্শ্ববর্তী সাহেবগঞ্জে আফিসানি স্থানান্তরিত করেন। ঐ সময় চাঁচড়ার রাজগণ ঐ জন্য গবর্ণমেন্টকে ৫০০ বিঘা ভূমিদান করিয়াছিলেন। পাঠান আমলে মুড়লীর নাম ছিল মুড়লী কসবা (সহর)। হেঙ্কেলের সময়ে ইংরাজ কর্মচারীরা কেহ কেহ একটু পশ্চিমদিকে ভৈরব-তীরে যেখানে আসিয়া বাস করিতেছিলেন, উহাকে সাহেবগঞ্জ বা সংক্ষেপতঃ কসবা বলিত। ঐ কসবায় যশোহর জেলার আফিস আদালত আসিলে কর্তৃপক্ষ উহারই নাম রাখিলেন, যশোহর। কিন্তু সাধারণ লোকে উহাকে কসবাই বলিত, এখনও সাধারণ লোকের মধ্যে সে নাম লুপ্ত হয় নাই। ভৈরব নদ তখনই মরিয়া আসিতেছিল এবং উহা খেয়া নৌকায় পার হইতে হইত। তবে নদীর খাত সংকীর্ণ বলিয়া নৌকায় দড়ি বাঁধা থাকিত এবং উহাই টানিয়া লোকে এপার ওপার যাইত, এজন্য উহাকে 'দড়াটানার খেয়া বলিত। এখন সেখানে দড়াটানার পুল হইয়াছে। ভূষণার রাজস্ব সংগ্রহের তার যশোহরের উপর পড়িলে, মহম্মদপুর অপেক্ষাকৃত কেন্দ্রস্থান এবং স্রোতস্বিনী মধুমতীর তীরবর্তী বলিয়া ১৭৯৫ অব্দে তথায় সদর ষ্টেশন স্থানান্তরিত করিবার কথা উঠিয়াছিল। কিন্তু সে মতলব কার্যে পরিণত হয় নাই। এখন মহম্মদপুরে একটি থানা ও রেজেষ্ট্রী আফিস মাত্র আছে। হেঙ্কেলের সময় জজ, ম্যাজিষ্ট্রেট ও কালেক্টরের পদ সম্মিলিত হয়, রোক সাহেবের সময় ঐরূপই ছিল; ১৭৯৩ অব্দে তিনি চলিয়া গেলে; কালেক্টরের পদ পুনরায় পৃথক্ হয়। পরে কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেটের এলেকা সব সময়ে এক ছিল না। এখন আবার পদদ্বয়ের সম্মিলনের সঙ্গে এলেকারও ঐক্য হইয়াছে। ১৮৬৪ অব্দে যশোহরে প্রথম মিউনিসিপালিটি হয়, এখন উহা পার্শ্ববর্ত্তী কতকগুলি গ্রামের উপর বিস্তৃত হইয়াছে। যশোহর ব্যতীত কোটচাদপুর ও মহেশপুরে আর দুইটি মাত্র মিউনিসিপালিটি আছে, কিন্তু উহার কোনটি মহকুমা নহে।
বিঃদ্রঃ - লেখাটি সতীশচন্দ্র মিত্রের 'যশোহর-খুলনার ইতিহাস' গ্রন্থ থেকে সংকলিত।