শ্রীল ভক্তিপ্রমোদ পুরী গোস্বামী ঠাকুর |
শ্রীল ভক্তি প্রমোদ পুরী গোস্বামী ঠাকুর যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার গঙ্গানন্দপুর গ্রামে কপোতাক্ষ নদের তীরে ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দে ১৮ই অক্টোবর, ২রা কার্ত্তিক ১৩০৫ বঙ্গাব্দ, বুধবার গৌর চতুর্থী তিথিতে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে আবির্ভূত হন। তার পিতা শ্রীতারিণীচরণ চক্রবত্তী এবং মাতা শ্রীরামরঙ্গিনী দেবী'। মাতাপিতা পুত্ররত্নের নাম রাখেন 'প্রমোদভূষণ চক্রবর্তী"।
প্রমোদভূষণের জন্মের পূর্বে তার মাতাপিতা চার বছরের এক কন্যা এবং এক বছরের একটি পুত্রকে হারিয়েছিলেন। তাই সন্তান লাভের আশায় রামরঙ্গিনী দেবী গ্রামের বৃদ্ধ-শিব মন্দিরে আরাধনা করেন। শিবের আশির্বাদেই শ্রীতারিণীচরণ চক্রবর্তী ও রামরঙ্গিণী দেবীর গৃহে শ্রীপ্রমোদ ভূষণের জন্ম হয়। এজন্য শৈশবে প্রমোদভূষণকে 'শিবের বরপুত্রী বলা হত। সেই সময়ের প্রথা অনুযায়ী রামরঙ্গিনী দেবী তিনটি কড়ির বিনিময়ে ধাত্রীমাতার কাছ থেকে প্রমোদ ভূষণকে ক্রয় করেছিলেন বলে, শিশুর নাম হয় 'তিনকড়ি'। সকলে ভালবেসে তিনু বলে ডাকতেন। পরবর্তীতে তিনুর আরও দুটি ভাই ও দুই বোনের জন্ম হয়। তাদের নাম বিনোদবিহারী, ননীগোপাল, শিবাণী ও কাঙায়নী। ছোট ভাই বিনোদবিহারী শৈশব অবস্থাতেই কলেরায় মারা যায়।
তারিণীচরণ চক্রবর্তী মহাশয় গঙ্গানন্দপুরের পাশের গ্রামের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। যদিও তিনি একজন দরিদ্র স্মার্ত ব্রাহ্মণ ছিলেন, কিন্তু পরিবারে খাদ্যদ্রব্যের কোন অভাব ছিল না। প্রমোদভূষণকে তার নিজের গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হল। শ্রেণীকক্ষে সে শীঘ্রই নিজেকে বুদ্ধিদীপ্ত ও অধ্যবসায়ী ছাত্র হিসাবে প্রমাণ করল। সে গ্রামবাসীদের বলত, “লোকে বিদ্যা অর্জন করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার জন্য। যদি তাই না হয়, তাহলে বিদ্যায় কী লাভ?”
“পড়ে কেনে লোক?- কৃষ্ণভক্তি জানিবারে।
সে যদি নহিল তবে বিদ্যায় কি করে।।।”
(চৈঃ ভা: আদি ১২/৪৯)
বিদ্যালয়ে প্রমোদভূষণ সর্বোত্তম ছাত্র হিসাবে পরিচিত হল। একই সাথে, সমগ্র গ্রামের জীবন ও আত্মাস্বরূপ শিব ঠাকুরের প্রতিও প্রমোদভূষণ চরমভাবে উৎসর্গীকৃত ছিল। প্রমোদভূষণ ও শিবের মধ্যে এক বিশেষ বন্ধন দেখে গ্রামবাসীরা আশ্চার্যান্বিত হয়ে যেত। সাধারণত, তারা তাদের শিশুদের পড়াশোনার ক্ষতি হতে পারে ভেবে শিব মন্দিরে বা কোন উৎসব অনুষ্ঠানে যেতে দিত না। কিন্তু প্রমোদভূষণ প্রতিদিন শিব মন্দিরে যেত এবং দীর্ঘক্ষণ পূজা-অর্চনা করত। তবুও বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষায় সে সর্ব্বোচ্চ নম্বর পেত। গ্রামবাসীরা তার এই আসাধারণ বিদ্যার প্রতিভা দেখে বিস্মিত হত।
একদিন প্রমোদভূষণের মা রামরঙ্গিনী দেবী মাছ রান্না করার জন্য মাছের আঁশ ছাড়াচ্ছিলেন। মাছটি জ্যন্ত ছিল তাই তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। ঐদিন কোন এক কারণ বশতঃ বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পূর্বেই ছুটি হয়ে যায়। এইজনা করেনি। ছোট্ট প্রমোদভূষণ আকস্মাৎ স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই মাছের প্রতি মায়ের নিষ্ঠুর আচরণ লক্ষ্য করে। ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে প্রমোদভূষাণের চোখে জল চলে আসে। সে খুবই দয়াশীল অভিব্যক্তি নিয়ে এই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মা ভাবছিল, " হয়ত আজ স্কুলে আমার ছেলের সাথে কোন সহপাঠীর ঝগড়া হয়েছে।” তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তিনি স্নেহপরায়ণ হয়ে বলতে লাগলেন, “ তিনু আজ কী তোমার কিছু হয়েছে? কেউ কী তোমায় তিরস্কার করেছে? আমাকে বল, কে তোমায় কী বলেছে?"
বারংবার অনুসন্ধান করায়, প্রমোদভূষণ সাশ্রু বদনে উত্তর দিল, “কেন তুমি আমাকে কেটে টুকরো করে রান্না করছ না? আমিও তো ঐ মাছটার মতোই অসহায়। কিভাবে তুমি এই রক্তাক্ত মাছকে পরিষ্কার করে রান্না করে খেতে পার। আমরা সকলে নিজেদেরকে মানুষ বলে পরিচয় দিই কিন্তু একটা অসহায় জীবকে হত্যা করে তাকে খাওয়াটা কোন মানুষের শোভা পায় না। ভগবান মানুষের শরীরটা সৃষ্টি করেছে শাকসব্জি ও শষ্য খাওয়ার জন্য। ভগবানের অভিমত অনুযায়ী মাছ খাওয়াটা বেআইনী ও পাপ। যারা অপরাধ মূলক কাজ করে এবং যারা তাদের সেই কার্যকে প্রশ্রয় দেয় তারা উভয়ই অপরাধী। সেকারাণে আজ থেকে যদি তুমি রান্নাঘরে মাছ নিয়ে আসো, তাহলে এখানকার রান্না করা কোন খাবার আমি কখনোই গ্রহণ করব না। এটাই আমার স্থির সংকল্প।"
ছোট্ট ছেলেটির এই বুদ্ধিদীপ্ত কথা শুনে, মাতা রামরঙ্গিনীদেবী আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তিনি তার ছেলের যুক্তি সঙ্গত কথা শুনে রাজী হয়ে গেলেন। সেইদিন থেকে রান্নাঘরে আর কখনই মাছ প্রবেশ করেনি।
একদিন প্রমোদভূষণ তার মায়ের সাথে গোশালায় গিয়েছিল। তার মা মনোযোগ সহকারে গরুগুলির দেখাশোনা করছিলেন আর সে তার মায়ের পাশে বসে ছিল। তাদের পাঁচটি গরু ছিল, তার মধ্যে একটি গরু দুধ দিত না। প্রমোদভূষণ পর্যবেক্ষণ করল যে, তার মা যেসব গাভীরা দুধ দেয়, তাদের মুখরোচক ও পুষ্টিদায়ক খাদ্য যেমন- সরষে ও তিসির খোল, মুগডালের দানা, গমের ভুসি, গুড প্রভৃতি দিচ্ছে আর যে গুরুটি দুধ দেয় না তাকে সেইসব খাবার দিচ্ছে না, শুধু খড় দিচ্ছে। এই সমস্ত বৈচিত্র্যময় গো-খাদ্য বণ্টন দেখে ছোট্ট বালক প্রমোদভূষণ বিস্ময়ান্বিত চিত্তে উৎসুক নেত্রে মাকে জিজ্ঞাসা করল; “মা। তোমার এরূপ বৈচিত্র্যময় খাদ্য বন্টন কেন?”। যদিও তার মা গ্রাম্য মহিলা ছিলেন কিন্তু তিনি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী ছিলেন। তিনি প্রমোদভূষণের প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন এবং স্নেহবশত বললেন, “তিনু। কেন তুমি এসব জিজ্ঞাসা করছ? তোমার এরকম প্রশ্ন করার প্রয়োজন নেই।” শিশু প্রমোদভূষণ চিন্তিত হয়ে বললেন, “মা, আমি শুধু জানতে চাইছি এই গরুটার পেটে কি কোন অসুখ হয়েছে। অথবা কী এমন হয়েছে যে, তুমি এই গরুটি ছাড়া অন্য গরুদের পুষ্টিকর খাবার দিচ্ছে?"
বুদ্ধিমতী মা রামরঙ্গিনী দেবী চিন্তা করলেন, তার পুত্র প্রমোদভূষণ নিশ্চয়ই তাকে আবার কোন ভালো শিক্ষা দেবে। তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন এবং তারপর বললেন, " তিনু। আমরা দরিদ্র ব্রাহ্মণ। আমাদের খুব সাবধানে জীবন যাপন করতে হয়। বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে তোমার বাবা যা উপার্জন করে তা আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই দুধ বিক্রী করে আমরা কিছু অর্থ উপার্জন করি। এই গরুগুলিকে ভালো খাবার দিই যাতে করে তারা বেশী দুধ দেয়। যতটা আমাদের প্রয়োজন ততটা দুধ আমরা পান করি আর বাকি দুধ বিক্রি করে গরুদের জন্য খাবার কেনা হয়। এই গরুটি এখন দুধ দিচ্ছেনা, তাই একে সাধারণ খাবার দিচ্ছি। যদি একেও উচ্চমানের খাবার দিই তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে।"
তার মায়ের এই যুক্তিপূর্ণ কথা শোনার পর, শিশু প্রমোদভূষণ কাদতে কাদতে বলতে লাগল, “মা আমিও তো কোন কাজ করি না। আমি কোন অর্থ উপার্জন করতে পারি না। তাহলে তুমি আমাকে ভালো ভালো খাবার খেতে দাও কেন? দুধ না দেওয়া গরুটির মতো তুমি আজ থেকে আমাকে নিম্নমানের খাবার দেবে আর তোমরা যারা অর্থ উপার্জন করছে তারা ভালো খাবার খাবে। যখন থেকে আমি অর্থ উপার্জন করে পরিবারে আর্থিক সহায়তা করতে পারব তখন থেকে তুমি আমাকে ভালো খাবার দেবে।” প্রমোদ ভূষণের কথা শুনে সেদিন থেকে রামরঙ্গিনী দেবী গাভীদের খাবার দেওয়ার সময় পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গী ত্যাগ করলেন।
এভাবে, শৈশবকাল থেকে প্রমোদভূষণ সমস্ত জীবের প্রতি দয়া দেখিয়েছেন। এটা সাধুর একটি বিশেষ গুণ। “সুহৃদঃ সর্বদেহিনাম” অর্থাৎ সাধুরা সমস্ত জীবের হিতাকাঙ্ক্ষী। তারা সমস্ত জীবের প্রতি দয়াশীল।
গঙ্গানন্দপুর গ্রামে অনেক পুকুর ছিল, কিন্তু নদীতে স্নান করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। তাই গ্রামবাসীরা অনেকেই কপোতাক্ষ নদে স্নান করত। বর্ষাকালে বন্যা হত। সে সময় নদের জলে স্রোত থাকার জন্য রামরঙ্গিনী দেবী তার সন্তানদের কাকার সাথেই স্নান করতে পাঠাতেন। একদিন প্রমোদভূষণ নদের তীরে দাঁড়িয়ে সকলের স্নান করা দেখছিল। এমন সময় হঠাৎ জলের উপরে একটা কুমির দেখে সে চিৎকার করে উঠল, "কুমির। কুমির। সকলে জল থেকে উঠে এস।" প্রমোদভূষণ পরোপকারী ও হিতাকাঙ্ক্ষী ছিল। যারা স্নান করছিল 'কুমির' শব্দটি শোনামাত্র, প্রত্যেকেই দ্রুত ভয়ে জল থেকে উঠে এল। প্রত্যেকেই মন থেকে প্রমোদভূষণকে অনেক কৃতজ্ঞতা জানাল, “ভাই। আজ আমরা তোমার জন্য প্রাণে বাঁচলাম।" এই ঘটনা ভবিষ্যতের এক ঝলক ছিল। আজ সে কুমিরের কবল থেকে গ্রামবাসীদের বাচাল, একদিন সে মায়ার কবল থেকে জগৎবাসীকে বাঁচাবে। জগতে কৃষ্ণনাম প্রচার করবে।
একদিন, প্রমোদভূষণের কাকা শিশুদের সাথে ঐশ্বর্যশালী খেলা উপভোগ করার জন্য প্রতিবেশী গ্রামের জমিদারের কাছ থেকে একটা পালিত হাতি ভাড়া করে এনেছিলেন। তিনি ভাইপো-ভাইঝিদের হাতির পিঠে চড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। বৈষ্ণবরা কখনো জাগতিক ঐশ্বর্যর প্রতি লালায়িত হয় না। তাই প্রমোদভূষণ হাতির পিঠে বসেছিল কিন্তু কোন আনন্দ উপভোগ করেনি। সে বৈষ্ণবীয় গুণে পরিপূর্ণ ছিল। এত অল্প বয়সে প্রমোদভূষণের এই প্রকার মানসিকতা দেখে প্রতিবেশীরা ভাবল, সে কোন সাধারণ ছেলে নয়, সে অবশ্যই এক মহাপুরুষ যাকে ভগবান কোন এক বিশেষ কার্য সম্পাদন করতে পাঠিয়েছেন।
ভগবৎ ইচ্ছায় শ্রীমনীন্দ্রনাথ দত্ত শ্রীপ্রমোদভূষণের প্রতিবেশী ছিলেন। শ্রীমণীন্দ্রনাথ দত্ত শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের গুরুভ্রাতা ছিলেন। তাঁর পারমার্থিক নাম ছিল শ্রীভক্তিরত্ন ঠাকুর। তাঁর গৃহে শ্রীমদনামোহনের সেবা হত। ছোটবেলা থেকে শ্রীভক্তিরত্ন ঠাকুরের নয়। সাথে প্রমোদভূষণের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। একদিন শ্রীপ্রমোদভূষণ ভক্তিরত্ন ঠাকুরকে বললেন, --
"আপনার আদেশে আমি শ্রীশ্রীরাধা মদনমোহানের সেবাপূজা করতে চাই।" একথা শোনা মাত্রই, শ্রী মনীন্দ্রনাথ দত্ত মহাশর আনন্দের সাথে জানালেন, “তুমি নিজেই যখন এই সেরা চাইছ, তাহলে তুমি সময় পেলেই এখানে চলে এসো এবং কোন সঙ্কোচ না করে শ্রীবিগ্রহের সেবা কর। এটা জীবন্ত বিগ্রহ। কখনো ভেব না এটা পাথরের তৈরী। এই বিগ্রহ সাক্ষাৎ শ্রীশ্রীরাধা মদনমোহন।" শ্রীরাধা মদনমোহন সত্যিই যে সাক্ষাৎ বিগ্রহ ছিলেন তা নীচের ঘটনা থেকে পরিস্কার হয়ে যাবে।
প্রতিদিন দত্ত পরিবারের লোকজন, বাড়ির পাশের একটা গাছ থেকে খেজুর রস এনে শ্রীরাধা মদনমোহনকে নিবেদন করত। একদিন মদনমোহন নিজেই চলে গেল এবং গাছে উঠে খেজুর রস পান করতে শুরু করল। যে ব্যক্তি খেজুর রস গাছ থেকে নামিয়ে আনে, সে দেখল গাছে উঠে কেউ রস পান করছে। তাই সে যখন মদনমোহনকে ধরতে গেল, তখন সে পালিয়ে এসে দত্ত বাড়িতে প্রবেশ করল। সেই ব্যক্তি তাকে অনুসরণ করতে করতে দত্ত বাড়িতে এসে সেই ছেলের নামে অভিযোগ করল। পরিবারের সকলেই আশ্চর্য হয়ে গেল।
কারণ এই রকম কোন কালো ছেলে তাদের বাড়িতে নেই। তথাপি তারা বাড়ির সমস্ত ছোট ছেলেদের একত্রিত করে জিজ্ঞাসা করল এবং ছেলেগুলি এই বিষয়ে কিছুই জানে না বলে খেলতে চলে গেল। তখন ভক্তিরত্ন ঠাকুর ঠাকুরঘরে প্রবেশ করে দেখল বিগ্রহের গায়ে সরষে ফুল ও খেজুর কাঁটা। তৎক্ষণাৎ তিনি বুঝতে পারলেন খেজুর রস খেতে যাওয়া কালো ছেলেটি মদনমোহন ছাড়া আর কেউ
একদিন ভক্তিরত্ব ঠাকুর প্রমোদ ভূষণকে বললেন, “মদনমোহনের সেরাটা আত্মবৎ, আমরা সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত যেমন নিজেদের সন্তুষ্টির জন্য সবকিছু করি, ঠিক সেইভাবে মননামোহনের জন্যও সবকিছু করা উচিত।”
এক শীতের রাতে প্রমোদভূষণ মদনমোহনকে শয়ন দেওয়ার সময় ঘটনাক্রমে কম্বল দিতে ভুলে গেল। ঐ রাত্রে সে সারা রাত ধরে জ্বরে ভুগল এবং ঠাণ্ডায় খুব কষ্ট পেল। ওদিকে মদনমোহন ভক্তিরত্ন ঠাকুরকে অভিযোগ করল, “আমি ঠাণ্ডায় কষ্ট পাচ্ছি।” আসলে, মদনমোহনই ইচ্ছাকরে প্রমোদভূষণকে ভুলিয়ে দিয়েছিল যাতে করে সে নিজেকে তাঁর ভক্তের কাছে প্রকাশিত করতে পারে এবং প্রমোদভূষণও উপলব্ধি করতে পারে যে, বিগ্রহ কোন পুতুল নয়, সাক্ষাৎ ব্রজেন্দ্রনন্দন। পরের দিন খুব ভোরে, প্রমোদভূষণ জ্বর অবস্থাতেই মদনমোহন। মন্দিরে এসে উপস্থিত হলে ভক্তিরত্ব ঠাকুর তার শারীরিক কষ্টের প্রতি কোনরকম দৃষ্টিপাত না করে তাকে বললেন, পানা পুকুরের ঠাণ্ডা জলে ডুব দিয়ে এসে মদনমোহনকে কম্বল দাও, তাহলে তুমি সুস্থ হয়ে যাবে।" প্রমোদভূষণ ভক্তিরত্ন ঠাকুরের নির্দেশ পালন করল এবং সাথে সাথেই সে জ্বর থেকে মুক্তি পেল। সেদিন সে সত্যিই মদনমোহনের কৃপা উপলব্ধি করল। দীক্ষা গ্রহণ করার আগেই, প্রমোদভূষণের শ্রীবিগ্রহের সাথে পারস্পরিক আদানপ্রদানের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হল। এই ঘটনার পর প্রমোদভূষণের শ্রীবিগ্রহ সেবার প্রতি বিশ্বাস ও ভক্তি ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকল।
প্রমোদভূষণের শৈশবের কৃতকর্ম ও আচরণ পর্যবেক্ষণ করে ভক্তিরত্ন ঠাকুর তাঁর দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পেলেন যে, ভবিষ্যতে প্রমোদভূষণ একজন আচার্য্যের লীলা করবে। তাই তিনি প্রমোদভূষণকে বিদ্যালয়ের পাঠের পাশাপাশি অবসর সময়ে অধ্যয়নের জন্য শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের রচিত সমস্ত শাস্ত্রগ্রস্থ দিলেন। প্রমোদভূষণ সেগুলি অধ্যয়ন করতে লাগল। ক্রমে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের রচিত দুর্লভ গ্রন্থগুলি তার কাছে প্রকৃত পাঠ্য বইয়ে পরিণত হল। তবে একটি আশ্চর্যের বিষয় হল প্রমোদভূষণের এই গ্রন্থগুলি অধ্যয়ণের সময় মনে হত, যেন সেগুলো সে আগে কখনো পড়েছে।
পরবর্তীতে শ্রীপ্রমোদ ভূষণ জ্ঞাতি কাকা শ্রীখগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কৃপায় ডায়মণ্ড হারবার লাইনে বারুইপুর হাইস্কুলে ভর্তি হন। বারুইপুরের নিকটবর্তী গ্রামের নাম "শাসন। সেই গ্রামে ননীগোপাল চট্টোপাধ্যায়, নন্দগোপাল চট্টোপাধ্যায় ও সরোজ কুমার চট্টোপাধ্যায় নামক জমিদারদের পরিবারে প্রমোদ ভূষণের থাকার ব্যবস্থা হয়।
১৯১৫ সালে শ্রীপ্রমোদভূষণ তাঁর সহপাঠীদের নিয়ে শ্রীধাম মায়াপুর দর্শনে যায়। বন্ধুদের নিয়ে মায়াপুরের বিভিন্ন স্থান দর্শন করতে করতে গঙ্গার অপর পারে যায়। সেখানে একটি কোন্দল চলছিল। শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজ এই দিনে অপ্রাকৃত শরীর ত্যাগ করেন। তাঁর শরীর নিয়ে কোন্দল উপস্থিত হয়। তখন শ্রীল প্রভুপাদ সদর্থক যুক্তি দিয়ে বাবাজী মহারাজের শরীরকে সমাধি
দিয়ে মায়াপুরে ফিরে যান। সেই স্থানেই শ্রীল প্রভুপাদের সাথে প্রমোদভূষণের সাক্ষাৎ হয়। শ্রীল প্রভুপাদের সুন্দর অবয়ব দর্শনে এবং অপ্রাকৃত কথা শ্রবণে প্রমোদভূষণ মুগ্ধ হয়ে যায়। শাসন গ্রামে ফিরে এসে তাঁর আর কিছুই ভাল লাগে না। এদিকে তাঁর ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার সময়ত উপস্থিত হয়। প্রত্যেকেই প্রমোদভূষণের ফলাফলের অপেক্ষায় থাকে। প্রত্যেকের আশানুরূপ ফলও হয়। সেই বিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রমোদভূষণের মতো নাম্বার কখনও কেউ পায় নি। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে সোনার মেডেল উপহার দেয়।
১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীপ্রমোদভূষণ কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হল। এরই মধ্যে শ্রীল প্রভুপাদের সাথে শ্রীধাম মায়াপুরে তার দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়। সে শ্রীল প্রভুপাদের প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে পড়ে যে, জাগতিক পড়াশোনার দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে পারেনি। যাইহোক পরীক্ষার ফল আশানুরূপ না হলেও সে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়। পরিবারের আর্থিক সংকট মেটানোর জন্য সে পোর্ট কমিশনের অফিসে চাকুরীতে যোগ দেয়। ৬ মাস অফিসে কাজ করার পর বউবাজারে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে মা ও ছোট বোনকে গঙ্গানন্দপুর থেকে নিয়ে এসে নিজের কাছে রাখতে শুরু করে।
একদিন প্রমোদভূষণ জানতে পারল, একজন বৈষ্ণব উল্টোডাঙ্গা জংশন রোডে শ্রীমন্ত্রাগবত পাঠ করছেন। সেইদিন বিকালে অফিসের কাজ সেরে সে ঐ বৈষ্ণবের দর্শনে গেল। সেখানে গিয়ে সে আশ্চর্য হল। কারণ সেই বৈষ্ণবটি আর অন্য কেউ নয় শ্রীল প্রভুপাদ। তাঁকে দেখে প্রমোদভূষণ আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। শ্রীল প্রভুপাদ তার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন। প্রমোদভূষণও শ্রীল প্রভুপাদের কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন। অবশেষে শ্রীল প্রভুপাদ বললেন, “আমি এখন থেকে এখানেই থাকব, আপনি সময় পেলে মাঝে মধ্যে আসতে পারেন।"
প্রমোদভূষণ বলল, “আমি নিশ্চয়ই আসব। আমি আপনার শ্রীমুখ-নিঃসৃত হরিকথা শুনে ও আপনার সেবা করে আমার জীবন সফল করতে চাই।" শ্রীল প্রভুপাদ বললেন, “শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছা হলে নিশ্চয়ই হবে।"
পরদিন অফিসের কাজ শেষ করে প্রমোদভূষণ হরিকথা শ্রবণের জন্য শ্রীল প্রভুপাদের কাছে চলে গেল। বহু ভক্তের সমাগম। শ্রীল প্রভুপাদ হরিকথা কীর্তন করলেন। অদ্ভুদ ব্যাপার, প্রমোদভূষণ যেই প্রশ্নগুলো শ্রীল প্রভুপাদকে করবেন বলে ভেবে এসেছিল, শ্রীল প্রভুপাদ হরিকথার মাধ্যমেই সব বলে দিলেন। শ্রীল প্রভুপাদ যেন অন্তর্যামী সূত্রে শ্রীপ্রমোদভূষণের মনের কথা জানতে পেরেছেন। এভাবে যখনই প্রমোদভূষণের মনে কোন প্রশ্নের উদয় হয়, শ্রীল প্রভুপাদ হরিকথার মাধ্যমে তার সব উত্তর দিয়ে দেন। এভাবে প্রমোদভূষণ নিত্য শ্রোতা হয়ে গেল এবং প্রভুপাদের হরিকথার প্রতি তীব্রভাবে আকৃষ্ট হল।
প্রমোদভূষণ শ্রীল প্রভুপাদের হরিকথার প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছিল যে, কোন কিছুই তাকে প্রতি সন্ধ্যায় প্রভুপাদের হরিকথায় যোগদান করা থেকে বিরত করতে পারত না।
একদিন প্রমোদভূষণ অফিস থেকে বাড়ি ফিরল এবং পোষাক পরিবর্তন করল। শ্রীল প্রভুপাদের সান্ধ্যকালীন হরিকথা শ্রবণের জন্য সে জুতো পড়তে যাচ্ছিল, এমন সময় হঠাৎ জুতোর ভিতরে লুকিয়ে থাকা একটা কাকড়াবিছা তাকে দংশন করল। কাঁকড়াবিছার কামড় চরম যন্ত্রণাদায়ক। প্রমোদভূষণ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে গেল কিন্তু । শ্রীল প্রভুপাদের হরিকথা শোনার প্রতি তার আকর্ষণ এত বেশী যে, সেই তীব্র যন্ত্রণাও তাকে বাড়িতে ধরে রাখতে পারল না। তার মাঝেও এব্যাপারে কিছু জানালো না। সে দ্রুত মঠের উদ্দেশ্যে রওনা হল। শ্রীল প্রভুপাদের হরিকথার পারমার্থিক কোমলতা তার সেই তীব্র যন্ত্রণাকে ভুলিয়ে দিল, কিন্তু হরিকথা শেষ হলে, সে আবার তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগল। ব্যাথার যন্ত্রণায় প্রমোদভূষণের গৌরবর্ণ রক্তিম বর্ণে পরিণত হলে, শ্রীল প্রভুপাদ প্রমোদভূষণকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনার কিছু হয়েছে নাকি? প্রমোদভূষণ সমস্ত ঘটনাটিকে লুকানোর জন্য বলল না তেমন কিছু না। শ্রীল প্রভুপাদ ভগবানের প্রিয় পার্ষদ, নিত্যসিদ্ধ মহাপুরুষ। প্রমোদভূষণ নিজেকে লুকালে কি হবে, অন্তর্যামী সূত্রে তিনি সবকিছুই বিস্তারিতভাবে জেনে বললেন, “ঝাকড়াবিছা কামড়ানোর তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করেও হরিকথা শ্রবণের প্রতি আপনার কৌতূহল আমাকে বিস্মিত করছে। এভাবে ভাড়া বাড়িতে থেকে প্রতিদিন এখানে কেন এত কষ্ট করে আসছেন। আপনি আমার সাথে এখানে থাকলেই ভালো হবে। আপনি এখানে থেকেই অফিসে যাতায়াত করুন এবং আপনার পরিবারকে সহায়তা করুন। এখন থেকে আপনি মঠে থেকেই অফিসে যাওয়ার চেষ্টা করুন।" শ্রীল প্রভুপাদের সেই নির্দেশ প্রমোদভূষণের হৃদয়কে স্পর্শ করল। সে প্রভুপাদের আদেশকে অকপটে স্বীকার করে মনের আনন্দে ভাড়া বাড়িতে ফিরে গেল। সে এতটাই আনন্দিত হল যে সেই তাঁর যন্ত্রণার কথা ভুলে গেল।
মা রামরঙ্গিনী দেবী প্রমোদভূষণকে দেখে আত্ম শ্চর্য হলেন। তিনি বললেন, “আমার মনে হয়, আজ তোমার কিছু হয়েছে। পরম আনন্দে তোমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেছে, আবার মনে হচ্ছে তুমি কিছু একটা শারীরিক কষ্টও অনুভব করছ।” তখন প্রমোদভূষণ তার মাকে কাঁকড়াবিছার ঘটনাটি জানালো। শুনে রামরঙ্গিনীদেবী আশ্চর্য হয়ে গেলেন, “আজ এ আমি কি দেখছি, মনে হয় তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। তখন আমার কী হবে?” প্রমোদভূষণ উত্তর দিল, "মা! এই জগতে আমরা কেউই রক্ষাকর্তা নই; সবার মালিক কৃষ্ণ। শুধুমাত্র তিনিই পারেন আমাদেরকে রক্ষা করতে। অস্থির বা চিন্তিত হয়ো না। কাঁকড়াবিছার যন্ত্রণা কমানোর জন্য কি করতে হবে তাই বলো? রামরঙ্গিনী দেবী সে সময়ের প্রচলিত ওষুধ দিয়ে তার যন্ত্রণা প্রশমন করল। পরদিন সকালে সে পুরোপুরি সুস্থ অনুভব করল।
সে প্রতিদিনের মতোই স্বাভাবিকভাবে অফিসে গেল এবং অফিস থেকে মাঠে হরিকথা শ্রবণ করতে গেল। শ্রীল প্রভুপাদ তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, "কবে থেকে আপনি মঠে থেকে অফিসের কাজে যাওয়ার কথা ভাবছেন?” প্রমোদভূষণ বলল, “প্রভুপাদ। মাকে গঙ্গানন্দপুর গ্রামে পৌঁছিয়ে দিয়ে যত শীঘ্র সম্ভব আমি আপনার নিকট চলে আসব।"
একদিন প্রমোদভূষণকে চিন্তিত দেখে মা রামরঙ্গিনী দেবীর মনে সন্দেহ হল। তিনি প্রমোদভূষণকে জিজ্ঞাসা করলেন আজ তোমাকে অন্যরকম লাগছে কেন? তখন প্রমোদভূষণ শ্রীল প্রভুপাদের প্রস্তাবটি তার মাকে জানাল। সেই সংবাদটি যেন মায়ের হৃদয়ে ত্রিশূল বিদ্ধ হওয়ার মতো আঘাত করল। প্রমোদভূষণ বলল, “মা আমি ভেবেছি দূর্গা পূজার পর এই ভাড়া বাড়িটা ত্যাগ করব এবং গৌড়ীয় মঠে থাকব।” মায়ের দুঃশ্চিন্তা হল, যদি প্রমোদভূষণ প্রভুপাদের সঙ্গে সবসময় থাকে, তাহলে একদিন সেও গৈরিক বসন পরিধান
করে আমাদেরকে চিরকালের মতো ত্যাগ করবে। কে আমাদের এই দরিদ্র পরিবারকে দেখাশোনা করবে?" এসব চিন্তা করে, তিনি কাঁপতে লাগলেন। অপরদিকে প্রমোদভূষণ শ্রীল প্রভুপাদের নিত্য সঙ্গ পাবার আশায় পরম আনন্দের সাগরে ভাসতে থাকলো। তবে জন্মদাত্রী মায়ের দুঃখের কথা ভেবে সেও দুঃখ অনুভব করল।
দুর্গাপূজা শুরু হতে চলেছিল। দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান মায়ের হৃদয়ে প্রমোদভূবণের জন্মের সুমিষ্ট স্মৃতি জাগরিত করল। জন্মদিনের স্মৃতি আনন্দ দিলেও মা রামরঙ্গিনী দেবী চিন্তা করছিলেন যে, হয়ত ভগবান তার প্রিয় পুত্রকে তার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবেন। এই চিন্তায় তিনি অনবরত কাঁদতে থাকলেন। তিনি বুদ্ধিমতী ছিলেন। তাই তিনি প্রমোদভূষণকে বাড়িতে বন্দী করার উপায় খুঁজতে শুরু করলেন। তিনি ভাবলেন, যদি প্রমোদভূষণকে বিবাহের বন্ধনে বিজড়িত করা যায়, তাহলে সে এই মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাবে এবং পরিবারকে ত্যাগ করে গৈরিক বসন পরিধান করতে পারবে না। তাই একদিন তিনি প্রমোদভূষণকে বললেন, “তুমি গৌড়ীয় মঠে থেকে অফিসের কাজ করবে এটা ভালো কথা কিন্তু আমার একটা অনুরোধ আছে।"
প্রমোদভূষণ আনন্দ সহকারে জিজ্ঞাসা করল, "বল মা, কি তোমার অনুরোধ!” মা বললেন, “প্রথমে, তুমি প্রতিজ্ঞা কর তুমি আমার আদেশ অমান্য করবে না।" সে বলল, “আমার পক্ষে যতটা সম্ভব আমি চেষ্টা করব তোমার আদেশ পালন করতে।” তখন রামরঙ্গিনী দেবী বললেন, “আমি ভাবছি সামনের অগ্রহায়ণ মাসে তোমার বিবাহের আয়োজন করব।”
এই প্রস্তাবটি প্রমোদভূষণের হৃদয়ে তীরের মতো বিধল আবার সে মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে যে সে তার আদেশ পালন করবে। প্রমোদভূষণের কাছে এটা ছিল এক কঠিন পরীক্ষা। সে মাকে কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। এমন সময় গীতার একটি শ্লোক তার মনে পড়ে গেল-
“তেষাং সততযুক্তানাং ভজতাং প্রীতিপূর্ব্বকম্। দদামি বুদ্ধিযোগং তং যেন মামুপযাস্তি তে।।"
(গীতা ১০/১০)
অর্থাৎ আমি আমার ভজনশীল সেককে বা ভক্তগণকে বুদ্ধিযোগ প্রদান করি যাতে করে তারা হল। আমার সেবা প্রাপ্ত হন।
প্রমোদভূষণ শ্রীল প্রভুপাদের চরণপদ্ম স্মরণ করে তার মাঝে বলল, "মা বিবাহের প্রসঙ্গে তোমার কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে। আগে বল তুমি আমাকে সত্য উত্তর দেবে।” তার মা পুত্র স্নেহে বিগলিত হয়ে বললেন, "হ্যাঁ, আমি তোমায় সত্য বলব।"
প্রমোদভূষণ মাকে জিজ্ঞাসা করল, “মা তুমি বিবাহ করেছ এবং আমাদেরকে এ জগতে নিয়ে এসেছ। এখন বল, বিবাহিত জীবনে তুমি কী সুখ লাভ করেছ?” এ কথা শুনে রামরঙ্গিনী দেবীর প্রমোদভূষণকে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ করার আশা ভঙ্গ হল। তিনি প্রমোদভূষণকে স্নেহের বশে আলিঙ্গন করে বললেন, "আমি তোমাকে আর কখনও বিবাহের কথা বলব না। তুমি আমাকে গঙ্গানন্দপুরে রোখে এসো। আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি শীঘ্রই আমাদের স্নেহের বন্ধন ত্যাগ করে শ্রীল প্রভুপাদের স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ হবে। সেই দিন আর বেশী দেরী নেই।" প্রমোদভূষণ তার মায়ের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত আশীর্বাদ গ্রহণ করল।
দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানের জন্য প্রমোদভূষণের অফিসে দশ দিনের ছুটি ছিল। সেই সুযোগে ষষ্ঠীর দিন সে মাকে নিয়ে গঙ্গানন্দপুর রওনা হল। বাড়ির
প্রত্যেকেই বিশেষ করে ছোটভাই ননীগোপাল তাদেরকে দেখে খুবই আনন্দিত হল। ননীগোপাল ভাবল দশদিন বড় দাদার সাথে আনন্দে কাটাতে পারবে। কিন্তু হায়। কোনভাবে তিনদিন কাটল, বিজয়া দশমীর দিন প্রমোদভূষণ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের বাহানা করে বাড়ি ত্যাগ করল। উল্টাডাঙ্গা জংশন রোডে শ্রীল প্রভুপাদের শ্রীমদ ভাগবদ পাঠ শ্রবণ করার তীব্র ইচ্ছায় সে সেখানে গিয়ে উপস্থিত
শ্রীল প্রভুপাদ ছিলেন সর্বজ্ঞ। প্রমোদভূষণকে দেখামাত্রই তিনি বললেন, "আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। শ্রীমন্মহাপ্রভুর বাণী প্রচার করার জন্য আপনাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। এখন থেকে আপনি আমার সাথে এখানে থাকবেন, অফিসের কাজে যোগদান করবেন এবং অবসর সময়ে শ্রীমন মহাপ্রভুর সেবা করবেন। "
শ্রীল প্রভুপাদের কথা শুনে প্রমোদভূষণ শ্রীমন্মহাপ্রভুর সেবায় যোগদানের জন্য পরমানন্দ লাভ করল। সে শ্রীল প্রভুপাদের চরণে দণ্ডবৎ প্রণতি জ্ঞাপন করে বলল, “আজ থেকে আপনি কৃপা করে আমার সেবার দায়িত্ব নির্দেশ করবেন। আমি খুবই বোকা। আপনার আদেশ এবং নির্দেশ ছাড়া আমি কিভাবে শ্রীমন্মহাপ্রভুর এই মূল্যবান সেবা সম্পাদন করতে পারব?" তখন শ্রীল প্রভুপাদ উত্তর দিলেন, “প্রমোদভূষণ, আপনার জন্য আমি দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছি। ১৯১৭ থেকে ১৯২১ পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম এবং এখন আমি আপনাকে শ্রীমন্মহাপ্রভুর বৃহৎ মৃদঙ্গের একজন বাদক এর সেবায় নিযুক্ত করার সুযোগ পেয়েছি। যদি আপনি আন্তরিকতার সহিত চেষ্টা করেন, তাহলে শ্রীমন্মহাপ্রভুর কৃপায় আপনি নিশ্চয়ই তাঁর সেবা করতে পারবেন। যাইহোক, আপনি অফিসের চাকরীটা করুন আর মা-বাবা এবং পরিবারের সকলকে আর্থিকভাবে সহায়তা করুন।"
প্রমোদভূষণ হাতজোড় করে বিনয়ীভাবে মৃদুস্বরে বলল, “যদি আমি মঠে এভাবে থাকি, তাহলে অন্য ভক্তরা আপত্তি করবেন না!" শ্রীল প্রভুপাদ উত্তর দিলেন, “সেটা আমার দারিত্ব।” “বিষয় খারাপ নয় কিন্তু যখন জড় বিষয়ের প্রতি আসক্তি বেশী হয়, তখন প্রকৃত সমস্যা শুরু হয়। আপনি মঠে থেকে অফিসের কাজ করবেন; এতে কোন দোষ নেই কিন্তু আপনি যদি জড় কাজে খুব বেশী আসক্ত হয়ে যান, তাহলে সমস্যা।" প্রমোদভূষণ উত্তরে বলল, “প্রভুপাদ। আপনার কৃপায় সবকিছুই সম্ভব।"
মঠের সমস্ত সেবা সুষ্ঠুরূপে সম্পাদন, তৎসঙ্গে অফিসের কাজ দুটোই শ্রীপ্রমোদভূষণ যথাযথভাবে পালন করতে লাগল। এভাবে দু'বছর কেটে গেল। ১৯২৪ সালে জন্মাষ্টমীর দুই দিন পূর্বে শ্রীল প্রভুপাদ প্রমোদভূষণকে বললেন,-
“কতদিন আর আপনি এই জাগতিক প্রমোদভূষণ হয়ে থাকবেন?” জড় প্রমোদের ভূষণ হলে চলবে না। আগামী পরশু কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী। ঐ দিন আমি আপনাকে জড় প্রমোদের ভূষণ থেকে পারমার্থিক প্রমোদের ভূষণে ভূষিত করাতে চাই।
জন্মাষ্টমীর দিন উপস্থিত। মঠে অনেক ভক্তবৃন্দের আগমন হয়েছে। ঠিক মঙ্গল আরতির পর, শ্রীল প্রভুপাদ প্রমোদভূষণকে বললেন, "আপনি কি প্রস্তুত?" প্রমোদভূষণ বলল, "আপনার কৃপায় আমি প্রস্তুত হতে পেরেছি।” তখন শ্রীল প্রভুপাদ বললেন, আপনি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছেন, তাই আলাদা করে কোন যজ্ঞ করার প্রয়োজন নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার ঘরে আসুন। একথা বলে শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর ঘরে ফিরে গেলেন। মঠের সমস্ত ভক্তবৃন্দ প্রমোদভূষণের দীক্ষানুষ্ঠানের কথা শুনে আনন্দিত হলেন। শ্রীল প্রভুপাদ প্রমোদভূষণকে হরিনাম ও দীক্ষা দিলেন। তার নতুন নাম হল- শ্রীপ্রণবানন্দ ব্রহ্মচারী।
প্রণবানন্দ প্রভু শ্রীল প্রভুপাদকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি কি সেবা করব?" শ্রীল প্রভুপাদ উত্তর দিলেন, “আজ থেকে আপনি কোন জড় আনন্দের যন্ত্র হয়ে থাকবেন না। এই কলমটি গ্রহণ করুন। এখন থেকে আপনি বৃহৎ মৃদঙ্গের সেবায় নিযুক্ত হবেন। বৃহৎ মৃদঙ্গ মানে ভক্তিগ্রন্থ ছাপানোর যন্ত্র। বৃহৎ মৃদঙ্গের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশ করে আপনি তা মানুষের মধ্যে প্রচার করুন। এতে মানুষের প্রকৃত উপকার হবে। লোক পরমানন্দে নিমগ্ন হবে। এই সেবাই আপনাকে প্রকৃত প্রণবানদে পরিণত করবে।"
প্রণবানন্দ প্রভুকে এভাবে নির্দেশ দেওয়ার পর, শ্রীল প্রভুপাদ জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনার নতুন গৈরিক বসন কোথায়?" শ্রীল প্রভুপাদের নির্দেশ অনুসারে প্রণবানন্দ প্রভু আগে থেকেই গেরুয়া বস্ত্র প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। তিনি সেটা শ্রীল প্রভুপাদকে দিলেন। শ্রীল প্রভুপাদ গেরুয়া বস্তুটি নিয়ে মন্দিরে গেলেন এবং কৃষ্ণের চরণে স্পর্শ করিয়ে শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজের হস্তে স্পর্শ করিয়ে প্রণবানন্দ প্রভুকে দিলেন।
শ্রীল প্রভুপাদের কৃপায় শ্রীপ্রণবানন্দ ব্রহ্মচারী নিষ্ঠার সাথে বৃহৎ মৃদঙ্গ তথ্য প্রকাশনা বিভাগের দায়িত্ব পালন করতে লাগলেন। এই সেবার জন্য তাঁকে দিনরাত কাঠোর পরিশ্রম করতে হত। তার সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে ১৯২৯ সালের ২৯শে মার্চ নবদ্বীপ ধাম প্রচারিণী সভায় তাঁকে 'প্রত্নবিদ্যালঙ্কার' উপাধি প্রদান করেন। তার চার বছর পর ১৯৩৪ সালে আবার 'মহোপদেশক' উপাধি প্রদান করেন।
১৯৩৬ সালের কার্তিক মাসে শ্রীল প্রভুপাদ পুরুষোত্তম মঠের চটক পর্বতে একটি গৌরবোজ্জ্ব অন্নকূট গোবন্ধন পূজা উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। সে সময় তিনি ২৫শে অক্টোবর থেকে ৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত চটক পর্বতে অবস্থান করেছিলেন। তারপর তিনি শ্বাসক্রিয়া জনিত সমস্যায় অসুস্থ লীলা প্রকাশ করলে কুঞ্জবিহারী বিদ্যাভূষণ প্রভু ও অন্যান্য বয়োঃজ্যেষ্ঠ শিযারা শ্রীল প্রভুপাদকে কলকাতার বাগবাজার গৌড়ীয় মঠে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। কুঞ্জবিহারী বিদ্যাভূষণ প্রভু শ্রীল প্রভুপাদকে ব্যক্তিগতভাবে যত্ন নেওয়ার দিন রাত ২৪ ঘণ্টাই ভক্তদের বিভিন্ন সময়ে দেখাশোনার দায়িত্ব দিলেন।
সে সময় একদিন প্রণবানন্দ ব্রহ্মচারী শ্রীল প্রভুপাদের ঘরে ছিলেন। শ্রীল প্রভুপাদ ইজি চেয়ারে বাসেছিলেন। প্রণবানন্দ প্রভু শ্রীল প্রভুপাদের চোখে অশ্রু দর্শন করে জিজ্ঞাসা করলেন, “শ্রীল প্রভুপাদ। যদি আপনি এই জড়জগৎ ত্যাগ করে চলে যান, তাহলে আমাদের কি হবে? কে আমাদের আশ্রয় দেবে?” শ্রীল প্রভুপাদ অশ্রুবিসর্জন করতে করতে বললেন, “কৃষ্ণ, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ”। মনে হচ্ছিল, শ্রীল প্রভুপাদ কৃষ্ণের বিরহে কাতর। প্রণবানন্দ প্রভুও ক্রন্দন করতে লাগলেন এবং শ্রীল প্রভুপাদের চরণপদ্ম তাঁর বক্ষে ধারণ করলেন। শ্রীল প্রভুপাদ যাবেন। ক্রন্দন করতে করতে বারংবার “কৃষ্ণ, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ” বলতে থাকলেন।
শ্রীল প্রভুপাদের অপ্রকটের কিছুদিন পূর্বে, শ্রীপাদ কুঞ্জবিহারী বিদ্যাভূষণ প্রভু ও শ্রীল ভক্তি রক্ষক শ্রীধর গোস্বামী মহারাজ শ্রীল প্রভুপাদের ঘরে অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীল ভক্তি রক্ষক শ্রীধর মহারাজকে আদেশ করলেন, “শ্রীরূপ মঞ্জরী পদ কীৰ্ত্তনটি করুন।" শ্রীল শ্রীধর গোস্বামী মহারাজ কীর্তন শুরু করবেন, এমন সময় কুঞ্জবিহারী বিদ্যাভূষণ মাঝঝখানে বাধা দিয়ে বললেন, “অপেক্ষা করুন, আমি প্রণবকে ডাকছি। তার সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর।" শ্রীল প্রভুপাদ বললেন, “আমি শ্রীধর মহারাজকে এই কীৰ্ত্তনটি করতে বলেছি। আমি প্রণবের সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর পরে শুনব।" কুঞ্জবিহারী বিদ্যাভূষণ প্রভু শ্রীল প্রভুপাদের ঘর থেকে বেড়িয়ে প্রণবানন্দ প্রভুর ঘরে গেলেন। তিনি প্রণবানন্দ প্রভুকে বললেন, "প্রণব, এসো! শ্রীল প্রভুপাদকে কীৰ্ত্তন শোনাতে হবে।” প্রণবানন্দ প্রভু একথা শোনা মাত্রই কুঞ্জবিহারী বিদ্যাভূষণ প্রভুকে অনুসরণ করলেন এবং শ্রীল প্রভুপাদের ঘরে প্রবেশ করলেন। ঠিক তখনই, শ্রীল প্রভুপাদ কুঞ্জবিহারী বিদ্যাভূষণের দিকে তাকিয়ে বললেন, "এখন শ্রীধর মহারাজ- কীৰ্ত্তন করুন।” তখন শ্রীল শ্রীধর গোস্বামী মহারাজ “শ্রীরূপ মঞ্জরীপদ" কীৰ্ত্তনটি করলেন। কীৰ্ত্তনটি শোনার পর শ্রীল প্রভুপাদ প্রণবানন্দ প্রভুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্রণব। তুমি এখন হরি হে দয়াল মোর জয় রাধানাথ কীৰ্ত্তনটি কর।” প্রণবানন্দ প্রভু সুমিষ্ট স্বরে কীর্ত্তনটি করলেন। কৃষ্ণের সাথে মিলিত হওয়ার এই তীব্র আকাঙ্ক্ষাপূর্ণ কীর্তনটি শোনার পর উপস্থিত ভক্তগণ বুঝতে পারলেন যে, শ্রীল প্রভুপাদ খুব শীঘ্রই তাদেরকে ছেড়ে গোলোক বৃন্দাবনে চলে যাবেন।
শ্রীপাদ কুঞ্জবিহারী বিদ্যাভূষণ প্রভু প্রণবানন্দ ব্রহ্মচারীকে প্রতিরাত্রে শ্রীল প্রভুপাদের সেবায় নিয়োজিত করেছিলেন। একহাতে তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করতে হত আর অন্য হাতে শ্রীল প্রভুপাদের নাকে অক্সিজেনের ফানেল ধরে থাকতে হত। ১৯৩৭ সালের ১লা জানুয়ারী ভোরবেলা (এটা থেকে ৫টা পর্যন্ত) প্রণবানন্দ প্রভু শ্রীল প্রভুপাদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তারপর শ্রীল প্রভুপাদের ব্যক্তিগত সেবক কৃষ্ণানন্দ প্রভু এই সেবা করার জন্য শ্রীল প্রভুপাদের ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন প্রণবানন্দ প্রভু পাশের ঘরে তাঁর শয়নকক্ষে গিয়ে বিছানায় বসলেন। তিনি ভাবছিলেন, “শ্রীল প্রভুপাদ এ জগত থেকে চলে গেলে কী হবে?
কয়েক মিনিটের মধ্যে কৃষ্ণানন্দ প্রভু প্রণবানন্দ প্রভুর ঘরে প্রবেশ করে বললেন, “প্রণব ! সব শেষ।" এটা ছিল ১৯৩৭ সালের ১লা জানুয়ারী ভোর ৫টা ৩০ মিনিট। বাগবাজার গৌড়ীয় মঠের সমস্ত ঘড়িগুলি ঠিক ৫টা ৩০ মিনিটেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গৌড়ীয় মঠের দীপ্তিমান সূর্য অস্তমিত হয়ে গেল। সমগ্র জগত অভাবনীয় অন্ধকারে পর্যবসিত হল।
তারপর শ্রীল প্রভুপাদের অপ্রাকৃত শ্রীঅঙ্গ বিশেষ ট্রেনে করে শিয়ালদা থেকে ধুবুলিয়া স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হল। সমগ্র ট্রেনে শুধু ভক্তরাই ছিলেন এবং তারা মহামন্ত্র কীর্ত্তন করছিলেন। ধুবুলিয়া স্টেশন থেকে শ্রীল প্রভুপাদের চিন্ময় শ্রীঅঙ্গ মায়াপুর শ্রীচৈতন্য মঠে নিয়ে যাওয়া হল। এক বিশাল শোভাযাত্রা। কুঞ্জবিহারী বিদ্যাভূষণ প্রভুর নির্বাচন অনুযায়ী শ্রীল ভক্তি গৌরব বৈখানস গোস্বামী মহারাজ, শ্রীল ভক্তি রক্ষক শ্রীধর দেব গোস্বামী মহারাজ এবং প্রণবানন্দ ব্রহ্মচারী শ্রীল প্রভুপাদের সমাধি কার্য সম্পন্ন করলেন। শ্রীল ভক্তিবিচার যাযাবর গোস্বামী মহারাজ শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুরের লিখিত বিরহ গীতি “যে আনিল প্রেমধন" কীর্তনটি করলেন। বিরহ কাতর ভক্তবৃন্দ শ্রীল প্রভুপাদের অদর্শনে ক্রন্দন করতে থাকলেন। আজ বহির্দৃষ্টিতে সকলেই তাদের অভিভাবককে হারিয়েছেন। সেখানে এক হৃদয়স্পর্শী ভক্তিপূর্ণ পরিবেশ অবস্থান করছিল।
শ্রীল প্রভুপাদের সমাধি অনুষ্ঠান ও বিরহ উৎসব পালিত হওয়ার পর প্রণবানন্দ প্রভু বাগবাজার গৌড়ীয় মঠে ফিরে আসেন। অনন্ত বাসুদের প্রভু ও সুন্দরানন্দ বিদ্যাবিনোদ প্রভুর তত্ত্বাবধানে ‘গৌড়ীয়’ পত্রিকা প্রকাশনার সেবা চালিয়ে যেতে থাকেন। সেই সময় অনন্ত বাসুদের প্রভু অর্থাৎ ভক্তিপ্রসাদ পুরী দাস ঠাকুরের শিষ্য অনন্ত দাস (পরবর্তীতে রাধাকুণ্ডের মহাস্ত হয়েছিলেন) প্রণবানন্দ প্রভুকে প্রকাশনা সেবায় সহায়তা করতেন। শ্রীল প্রভুপাদের ইচ্ছায় তারা অনেক ভক্তিমূলক গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। ভগবদ ইচ্ছায় মহাপ্রভুর প্রেমধর্ম্ম ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের নিমিত্ত ঐ সময় আচার্য্যের বঞ্চনা লীলাকে কেন্দ্র করে নিজেকে কোন বিবাদের মধ্যে না জড়িয়ে প্রণবানন্দ প্রভু ১৯৩৯ সালে শান্তিপূর্ণভাবে বাগবাজার গৌড়ীয় মঠ থেকে অন্যত্র চলে গেলেন।
প্রণবানন্দ প্রভু শ্রীল ভক্তি হৃদয় বন গোস্বামী মহারাজ ও সাধিকানন্দ প্রভুর (শ্রীল কৃষ্ণদাস বাবাজী মহারাজের) সাথে মিলিত হলেন। দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জের চারু এভিনিউ-এ একটি ভাড়া বাড়িতে তিন জানে থাকতে শুরু করলেন। তারা বিভিন্ন গৃহস্থ বাড়িতে প্রচার করতেন এবং ভিক্ষা করে যা অর্থ সংগ্রহ হত তাই দিয়ে ভাড়া বাড়িতে থেকে সাধন ভজন করতেন। একদিন তারা এক বিধবা মহিলার বাড়িতে হরিকথা পরিবেশন করতে গিয়েছিলেন। সেই বিধবা মহিলার ঘরে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ ছিল। তারা লক্ষ্য করলেন যে, রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ আলমারীতে রাখা আছে কিন্তু সেবা-পূজা করা হয় না। এত অপূর্ব বিগ্রহ দর্শন করে, প্রণবানন্দ প্রভু ঐদিন ঐ রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহের সেবা করেছিলেন এবং শ্রীল বন গোস্বামী মহারাজ হরিকথা পরিবেশন করেছিলেন। তারপর একদিন সূর্যোদয়ের পূর্বে তাদের ভাড়া বাড়ির দরজায় ঠকঠক শব্দ শোনা গেল। দরজা খোলার পর দেখা গেল সেই বিধবা মহিলা রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন, "গতরাত্রে এই বিগ্রহ তাকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে বলেছেন, যদি তুমি তোমার পরিবারকে বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে চাও, তাহলে সূর্যোদয়ের আগেই আমাদেরকে (বিগ্রহকে) প্রণবানন্দ প্রভুর হাতে সমর্পণ কর। তাই স্বপ্নাদেশের পর, আমি জেগে উঠে বিগ্রহ দুটি আপনাকে দিতে এসেছি। আপনি কৃপাপূর্বক গ্রহণ করে আমার পরিবারকে রক্ষা করুন।" প্রণবানন্দ প্রভু আশ্চর্য হয়ে চিন্তা করলেন, “ভগবান কত কৃপাময়।" তিনি আনন্দ সহকারে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ গ্রহণ করে ভগবানের কৃপা স্মরণ করতে করতে বিগ্রহের নাম দিলেন 'শ্রীরাধা গোপীনাথ'। প্রণবানন্দ প্রভু আনন্দের সহিত সেই বিগ্রহের সেবা করতে লাগলেন।
১৯৪০ সালে শ্রীল বন মহারাজ বিদেশে প্রচারে গেলে শ্রীপ্রণবানন্দ ব্রহ্মচারী যশোর গঙ্গানন্দপুর গ্রামে ফিরে যান। সেখানে মদনমোহন ঠাকুর বাড়িতে থেকে মদনমোহনের সেবাপুজা করতে থাকেন। সেখানে থাকা কালে তিনি 'শ্রীগোপীনাথ বিজ্ঞাপ্তি নামে একটি দীর্ঘ কীৰ্ত্তন রচনা করেন। তারপর বিভিন্ন গুরুভ্রাতাদের মঠে ভ্রমণ করেন। ১৯৪৫ সালের ২৯শে জানুয়ারী তাঁর মা দেহত্যাগ করেন।
প্রণবানন্দ প্রভু তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন যে, ১৯৩৩ সালে ভুবনেশ্বরের ত্রিদণ্ডী গৌড়ীয় মঠে শ্রীল প্রভুপাদ তাকে সন্ন্যাস দেওয়ার। পরিকল্পনা করেছিলেন কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৪২ সালে শ্রীল প্রভুপাদ প্রণবানন্দ প্রভুকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে তাঁকে সন্ন্যাস মন্ত্র প্রদান করেছিলেন। পরের দিন সকালে তিনি সেই মন্ত্র ডায়েরিতে লিখে রাখেন। ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রণবানন্দ প্রভু নবদ্বীপ ধাম পরিক্রমায় অংশ নেওয়ার জন্য
সতীর্থদের সাথে নবদ্বীপ ধামে এসেছিলেন। পরিক্রমার সময় উনি সেই স্বপ্নের কথা সতীর্থদের কাছে প্রকাশ করলেন।
১৯৪৭ সালের ৩রা মার্চ আমলকী একাদশী তিথিতে, শ্রীপ্রণবানন্দ প্রভু শ্রদ্ধের সতীর্থ শ্রীল ভক্তিগৌরব বৈখানস গোস্বামী মহারাজের কাছ থেকে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তাঁর সন্ন্যাস নাম হয় শ্রীল ভক্তি প্রমোদ পুরী গোস্বামী মহারাজ। শ্রীল ভক্তি প্রমোদ পুরী গোস্বামী মহারাজের সতীর্থ শ্রীল সৎপ্রসঙ্গানন্দ দাস ব্রহ্মচারী (সতীশ প্রভু) শ্রীল প্রভুপাদের আদেশানুসারে শ্রীশ্রী গৌরগদাধর বিগ্রহের সেবা লাভ করেছিলেন। তিনি সন্ন্যাস গ্রহণের সময় ত্রিদণ্ড বানানো এবং অন্যান্য আয়োজনে সহায়তা করেছিলেন। প্রত্যেকেই এই শুভ অনুষ্ঠানে আনন্দিত হয়েছিলেন।
“পতিতানাং সমুদ্ধারে যতিবেশধরায় বৈ।
প্রচারাচারকার্য্যে চ জাগরূকায় সর্বদা।"
আমরা শ্রীল পুরী গোস্বামী মহারাজের প্রণাম মন্ত্র থেকে জানতে পারি যে, তিনি এজগতের পতিত জীবদের উদ্ধার করার জন্য সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। মহাপ্রভুর বাণী প্রচার করতে তাঁর অনবদ্য ভজন ও প্রচার সর্বদা সক্রিয় ছিল। ১৯৯৩ সালে শ্রীল ভক্তি দর্শন আচার্য্য গোস্বামী মহারাজ, শ্রীল ভক্তি প্রমোদ পুরী মহারাজের প্রণাম মন্ত্র রচনা করেছিলেন। শিষ্যগণ ওনাকে 'ঠাকুর' বলে সম্বোধন করেন।
সন্ন্যাস গ্রহণের পর শ্রীল ভক্তিপ্রমোদ পুরী গোস্বামী ঠাকুর কিছুদিন শ্রীল ভক্তিপ্রজ্ঞান কেশব গোস্বামী মহারাজের উচ্চারণ গৌড়ীয় মঠে অবস্থান করেন। তারপর তিনি শ্রীকুঞ্জবিহারী বিদ্যাভূষণ তথা শ্রীল ভক্তিবিলাস তীর্থ গোস্বামী মহারাজের আনুগত্যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব স্থান যোগপীঠ মন্দিরে সেবা করেন। তিনি প্রায়শই বলতেন,--“কুঞ্জবাবুর আশির্বাদ ছাড়া কেউ শ্রীল প্রভুপাদের কুঞ্জ সেবা লাভ করতে পারবে না।” যোগপীঠে ৭ বছর সেবা করার পর তিনি শ্রীল ভক্তিবিলাস তীর্থ গোস্বামী মহারাজকে যথাযথ সম্মান জানিয়ে বিনীতভাবে যোগপীঠ মন্দির থেকে অম্বিকা কালনা খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
অম্বিকা কালনায় গিয়ে শ্রীল ভক্তিপ্রমোদ পুরী গোস্বামী ঠাকুর প্রথমে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। পরে শ্রীঅনন্ত বাসুদেব মন্দিরের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। কালনায় অবস্থানকালে শ্রীল ভক্তি প্রমোদ পুরা গোস্বামী ঠাকুর মন্দিরের বারান্দাতেই থাকতেন এবং করতেন। দিনে তিনবার পাঠ করতেন। কিছুদিন পর তিনি লক্ষ করলেন যে, হরিকথা শ্রবণ করতে আসা শ্রোতারা অধিকাংশই হল বৃদ্ধ ও অল্প সংখ্যক বিধবা মহিলা। তিনি অনুভব করলেন এভাবে অবস্থান করলে তিনি শ্রীল প্রভুপাদ কর্তৃক প্রদত্ত বৃহৎমৃদঙ্গের সেবা আদৌ করতে পারবেন না এবং শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা ও বাণীকে জগতে প্রচার করা সম্ভব হবে না। ১৯২৪ সালে দীক্ষামন্ত্র পাওয়ার সময় শ্রীল প্রভুপাদ তাকে বিভিন্ন প্রবন্ধ লেখা, সম্পাদনা করা, প্র সংশোধন করার আদেশ করেছিলেন। ভগবদ্ ইচ্ছায় ১৯৬১ সালে শ্রীল মাধব গোস্বামী মহারাজ শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুরকে তাঁর মঠে থেকে শ্রীচৈতন্য গৌড়ীয় মঠের প্রকাশনা বিভাগের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দেন এবং শ্রীচৈতন্য গৌড়ীয় মঠে থেকে প্রচার কার্যে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ করেন। শ্রীল প্রভুপাদের ইচ্ছা বা আদেশকে অবিরত পরিপূরণ করার পরবর্তী ধাপ হিসাবে তিনি শ্রীল মাধব গোস্বামী মহারাজের প্রস্তাবকে গ্রহণ করার কথা ভাবতে থাকেন।
শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুর অনন্ত বাসুদেব মন্দিরের সমস্ত বৈধ দলিল তাঁর ছোট ভাই ননীগোপালের নামে প্রস্তুত করে তাঁকে মন্দিরের সেবার দায়িত্ব দেন। তখন থেকে ননীগোপাল তাঁর পুরো পরিবারের সাথে মায়াপুর থেকে কালনায় এসে কালনা মন্দির দেখাশোনা করতে শুরু করেন। ১৯৬২ সালে শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুর কলকাতায় শ্রীল মাধব গোস্বামী মহারাজের প্রতিষ্ঠিত শ্রীচৈতন্য গৌড়ীয় মাঠে যোগদান করেন। তিনি শ্রীচৈতন্য গৌড়ীয় মঠের প্রকাশনা বিভাগের নেতৃত্ব দিতেন এবং বিভিন্ন সময় শ্রীল মাধব গোস্বামী মহারাজের সাথে প্রচার অনুষ্ঠানে যোগদান করে তাঁকে সহায়তা
শ্রীল ভক্তিপ্রমোদ পুরী গোস্বামী ঠাকুরকে তৃণাদপি শ্লোকের মূর্ত্ত বিগ্রহ বলা হত। তবে তিনি বৈষ্ণব অপরাধের বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। এমনি একটি ঘটনা-
একসময় শ্রীল মাধব গোস্বামী মহারাজ, শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুর এবং শ্রীল মাধব গোস্বামী মহারাজের শিষ্য যজ্ঞেশ্বর প্রভু (গোবিন্দ মহারাজ ) ব্রজমণ্ডল পরিক্রমা সমাপন করে হাওড়া স্টেশনে এসে উপস্থিত হলেন। তিনজনে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলেন, মালপত্র ভরলেন এবং কালিঘাট শ্রীচৈতন্য গৌড়ীয় মঠের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। এক বিশাল সংকীর্ত্তন দল তাঁদের স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শ্রীল মাধব গোস্বামী মহারাজ মিটারে নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী ট্যাক্সি ড্রাইভারকে সেই ভাড়া শোধ করে ট্যাক্সি থেকে নামলেন। এমন সময়, ট্যাক্সি চালক শ্ৰীল মাধব গোস্বামী মহারাজকে লক্ষ্য করে অপশব্দ বলতে লাগলেন। তার কারণ সে মালপত্রের জন্য কিছু অতিরিক্ত অর্থ আশা করেছিল। সকলে জানতেন, শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুর শিক্ষাষ্টকের তৃতীয় শ্লোকের প্রতিমূর্তি। কিন্তু ট্যাক্সি চালকের কথা শুনে তিনি চীৎকার করে বললেন, “এই, এনাকে বের কর।” সংকীর্তন দলের সমস্ত ভক্তরা শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুরের সুউচ্চ কণ্ঠস্বর শ্রবণ করে এগিয়ে এলেন। তিনি তাদেরকে বললেন, “ট্যাক্সি চালককে গাড়ি থেকে বের কর এবং শ্রীল মাধব গোস্বামী মহারাজের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করতে বল। সে বৈষ্ণব অপরাধ করেছে। যদি সে ক্ষমা না চায়, তাহলে সে নরকে যাবে।" সমস্ত ভক্তরা ট্যাক্সি চালককে টেনে বের করল। এত ভক্তদের দেখে সে ভয় পেয়ে গেল। সে তার ভুল বুঝঝতে পারল এবং শ্রীল মাধব গোস্বামী মহারাজের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করল। এই ঘটনা দেখিয়েছিল যে, শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুর কোমল স্বভাবের হলেও কখনো কখনো বজ্রের মতো কঠিনও হতে পারেন। তিনি সর্বদা কোমল স্বভাবের ছিলেন; কিন্তু যদি কেউ বৈষ্ণব অপরাধ করে, তাহলে তিনি তা সহ্য করতেন না।
১৯৮৬ সালে বিভিন্ন ভক্ত; বিশেষ করে গুরুভ্রাতা শ্রীমদন মোহন প্রভুর বিশেষ অনুরোধে শ্রীল ভক্তিপ্রমোদ পুরী গোস্বামী ঠাকুর মায়াপুরে শ্রীগোপীনাথ গৌড়ীয় মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে খুবই সামান্য জায়গা নিয়ে শুরু হয়। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে মঠের কলেবর বৃদ্ধি পায়। এরপরে কলকাতা, বৃন্দাবন এবং পুরীতেও শ্রীগোপীনাথ গৌড়ীয় মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে বিশ্বের বহু দেশে শ্রীগোপীনাথ গৌড়ীয় মঠের শাখা রয়েছে।
মায়াপুরের একটি অলৌকিক ঘটনা-- চন্দন যাত্রা অনুষ্ঠান চলাকালীন মায়াপুরে অত্যধিক গরম ছিল। সে সময় না এয়ার কণ্ডিশানার ছিল, না সিলিং ফ্যান চলার জন্য যথাযথভাবে বিদ্যুৎ থাকত। একদিন সকালে, শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুর ওনার ঘরে ধ্যানস্থ হয়ে আহ্নিক গায়ত্রী জপ করছিলেন। হঠাৎ উচ্চৈঃস্বরে ক্রোধিত হয়ে বললেন, “এখন মন্দিরে পূজারী কে আছে? এখনই তাকে ডাক।" পুজারী মন্দিরের ভিতরে ছিল। তিনি বিগ্রহের বস্ত্র পরিবর্তন করছিলেন”। শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুরের ডাক শুনে পূজারী তৎক্ষণাৎ মন্দির থেকে নেমে এসে শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুরের ঘরে গেলেন। শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুর উচ্চৈঃস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি মনে কর আমার বিগ্রহ কাঠের পুতুল কেন তোমার বাম হাতের কনুই দিয়ে গদাধরকে আঘাত করেছ?" পূজারী স্তম্ভিত। তিনি আরও বললেন, “যদি তুমি সত্যই এই ত্যক্তাশ্রমীর, জীবন কাটাতে চাও, তাহলে এখনই গদাধরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নাহলে তোমাকে অবশ্যই দুর্দশাগ্রস্ত জড় জীবনে প্রবেশ করতে হবে।" পূজারী একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। তিনি ভীত হয়ে শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুরের ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন। পূজারী চলে যাওয়ার পর ভক্তরা অনুসন্ধিৎসু হয়ে শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “গুরুদেব! মন্দিরের দরজা জানালা সব বন্ধ। আর ভিতরে তো পূজারী ছাড়া কেউ ছিল না। তাহলে এই ঘটনা আপনি কিভাবে জানলেন?” শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুর উত্তর দিলেন, “বাবা। গদাধর নিজে আমার কাছে এসে অভিযোগ করেছে, নাহলে আমি জানব কিভাবে? আমি বৃন্ধ এবং পঙ্গু। আমার ১৭ বছর বয়স। তোমরা সবাই ভাবছ আমি এখানে বসে আছি আর তোমরা যা ইচ্ছা তাই করবে। ভগবান আমাকে প্রতিটি বিষয়ে অবগত করান। এজন্য ভগবানের সেবায় কোন ভুল ত্রুটি আছে কিনা নিশ্চিতভাবে জানাবে। যদি কোন ভুল হয়ে যায় তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমি এখানে সশরীরে থাকি বা না থাকি, আমি সর্বক্ষণ মায়াপুর মন্দিরেই থাকব। তোমরা এর লক্ষণগুলি ক্রমে ক্রমে বুঝতে পারবে।” আরও একটি অলৌকিক ঘটনা
মে ১৯৮২। শ্রীল ভক্তি প্রমোদ পুরী গোস্বামী ঠাকুরের কৃপায় তাঁর এক শিষ্যার মাত্র ২২ বছর বয়সে বিবাহ হয়। বিবাহের প্রায় ছয়মাস পর ১৯৮২ সালের নভেম্বর মাসে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেন 'ব্লাড ক্যান্সার' এবং রোগীকে তিন সপ্তাহের বেশী বাচানো যাবে না। সেই অসুস্থ শিষ্যা শ্রীল গুরুদেবের প্রতি উৎসর্গীকৃত ছিলেন। তাই শরীর ত্যাগ করার আগে জীবনের শেষ কয়েকদিন শ্রীল গুরুদেবের চরণামৃত পাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। ডাক্তারের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, প্রস্তাবিত দিনের দু'সপ্তাহ আগে তিনি কলকাতা শ্রীচৈতন্য গৌড়ীয় মঠে শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুরের কাছে এলেন। সেসময় শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুর সকালের জপ, শ্রীবিগ্রহের পূজা ইত্যাদিতে ব্যস্ত ছিলেন। সকাল সাড়ে ১১ টায় পূজা শেষ হলে শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুর তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "তোমার স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়ে গেছে। কি হয়েছে?" তখন তিনি সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। তিনি আরও বললেন, “গুরু মহারাজ। আমি আপনার চরণামৃত চাই। আমি যে কদিন বাঁচব, প্রতিদিন এই চরণামৃত পান করব।" শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুর সঙ্গে সঙ্গে বললেন, "মা, রাখে হরি তো মারে কে? মারে হরি তো রাখে কে?" তারপর কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর, মৃদু স্বরে বললেন, “আমি জানি না আমার চরণামৃতে তোমার উপকার হবে কিনা? যদি তুমি সরাসরি কৃষ্ণের চরণামৃত পাও, তাহলে ভালো হবে।” এই বলে তিনি আদেশ দিলেন-- “মা তুমি বৃন্দাবনে যাও। তিনদিন পরে,
কৃষ্ণ কেশীঘাটে আসবেন এবং ভোর তিনটের সময় একটি বিশেষ স্তম্ভের কাছে স্নান করবেন। সে সময়: ঐ স্থান থেকে একটি পাত্রে করে কেশীঘাটের জল নিয়ে পান করবে। এটাই কৃষ্ণের সরাসরি চরণামৃত হবে। পরেরদিন দুপুর ১২টার সময় রাধাকৃষ্ণ একসাথে নিধুবনে প্রবেশ করবেন। ঠিক ১২টার পর নিধুবনের প্রবেশ দ্বার থেকে এক চিমটি ধূলো নিয়ে মুখে দেবে। এটাই রাধাকৃষ্ণের সরাসরি চরণধূলি। তারপর শ্রীহরির কৃপার অপেক্ষা কর। যদি তিনি তোমাকে নিতে চান, তাহলে তোমায় চলে যেতে হবে। যদি তিনি তোমাকে রাখতে চান, তাহলে তুমি থাকবে। এই নিয়ে চিন্তা কর না।" তারপর শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুর অসুস্থ শিষ্যার মাথায় গঙ্গা জল ছিটিয়ে বিভিন্ন প্রকার বৈদিক মন্ত্র পাঠ করলেন। যাইহোক, সেই শিষ্যা অতি শীঘ্রই সমস্ত আয়োজন করে বৃন্দাবন চলে গেলেন এবং শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুরের নির্দেশ অনুসরণ করলেন। আলৌকিক ভাবে তিনি অতি শীঘ্রই সুস্থ হয়ে গেলেন। তার ক্যানসার ভালো হয়ে গেল। এখনও পর্যন্ত তিনি সুস্থ আছেন।
আমরা জানি, শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর বলেছেন-- “আপন ভজন কথা না কহিবে যথা তথা," তথাপি শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুর তাঁর প্রিয় ভাজের জীবন বাঁচানোর জন্য রাধাকৃষ্ণের লীলা প্রকাশ করেছিলেন।
"যত দেখ বৈষ্ণবের ব্যবহার দুঃখ।
নিশ্চয় জানিহ সেই পরানন্দসুখ।।"
(চৈঃ ভাং মধ্য ৯/২80 ) ১৯৯৪ সালে শ্রী চৈতন্য গৌড়ীয় মঠে বাৎসরিক উৎসব চলাকালীন বোলপুর থেকে সুধীর পাঁজা নামক এক বিখ্যাত জ্যোতিষী এসেছিলেন। উনি শ্রীল ভক্তি দয়িত মাধব গোস্বামী মহারাজের শিষ্য ছিলেন। শ্রীল নয়নানন্দ দাস বাবাজী মহারাজ ও শ্রীল ভক্তি দর্শন আচার্য্য মহারাজ শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুরের ভজন কুটীরে উপস্থিত ছিলেন। তখন সুধীর পাঁজা গুরুদেব শ্রীল ভক্তিপ্রমোদ পুরী গোস্বামী ঠাকুরের হাতের তালু দর্শন করে বললেন, "মহারাজ। আপনার ৭০ বছর বয়সে দেহ ত্যাগ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন আপনার ৯৬ বছর বয়স। এটা কিভাবে সম্ভব তা আমি বুঝতে পারছি না। আপনার ইচ্ছামৃত্যু আছে।" তখন ভক্তরা সকলে আশা করেছিলেন যে, প্রভু জগন্নাথ অ্যাসবেস্টের ডাল থেকে তার সুরমা মন্দিরে স্থানান্তর হওয়া পর্যন্ত গুরুদের হয়তো প্রকটলীলা করবেন।
১৯৯৯ সালের ২৭ শে এপ্রিল ভোর ৩ টের সময় শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুর তাঁর অনুগত শিষ্যদেরকে দিব্য শ্রীঅঙ্গ সেবায় নিয়োজিত করার জন্য অসুস্থলীলাভিনয় প্রকাশ করলেন।
১৯৯৯ সালের ২২শে নভেম্বর রাত্রি ২টো ১০ মিনিটে রাসপূর্ণিমার আগের দিন চতুদশী তিথিতে তিনি নিত্যলীলায় প্রবেশ করলেন। মনে হয় তিনি রাধাগোপীনাথের রাসলীলায় প্রবেশের জন্য সঠিক সময়ের আপেক্ষা করছিলেন, গোলক বৃন্দাবনে নিত্য স্বরূপে তাঁর নিত্যসেবা পুষ্পচয়ন করে ললিতা দেবীকে অর্পণ করার নিমিত্তে ঐ রাসপূর্ণিমার পূর্বরাত্রে সকলকে তাঁর সাক্ষাৎ দর্শন থেকে বিরত করলেন।"
পুরীধামের ভক্তগণ তাঁর শ্রীঅঙ্গ মায়াপুর নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করলেন। গোপীনাথ খুঁটিয়া শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুরের জন্য জগন্নাথের মালা ও ধ্বজা নিয়ে এলেন। গোপীনাথ খুঁটিয়ার বাবা, হনুমান খুঁটিয়াকে শ্রীল প্রভুপাদ নিজে গৌড়ীয় মঠের পাণ্ডা হিসাবে নিয়োজিত করেন। শ্রীল পুরী
গোস্বামী ঠাকুরের শ্রীঅঙ্গ পুরী থেকে মায়াপুর নিয়ে যাওয়ার জন্য শ্রীল ভক্তি প্রপন্ন দামোদর গোস্বামী মহারাজের শিষ্য ললিত প্রভু একটি গাড়ি। ভাড়া হিসাবে দিলেন। অসংখ্য ভক্তগণ ও স্থানীয় বাসীন্দারা শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুরকে শেষবার দর্শন করতে এলেন। তারপর তাঁর পবিত্র শ্রীঅঙ্গ পুরীর সমুদ্রে নিয়ে যাওয়া হল এবং সেখান থেকে বালি সংগ্রহ করা হল। তাঁর শ্রীঅঙ্গ হরিদাস ঠাকুরের সমাধিতে নিয়ে গিয়ে পরিক্রমা করানো হল। তারপর ওনাকে ওখান থেকে জগন্নাথ মন্দিরের কাছে নিয়ে গিয়ে পতিতপাবন জগন্নাথ দর্শন করানো হল। সেখান থেকে শ্রীচৈতন্য গৌড়ীয় মঠে শ্রীল প্রভুপাদের আবির্ভাব স্থানে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে কৃষ্ণকেশব প্রভূ অর্থাৎ শ্রীল পুরী গোস্বামীর গুরুভ্রাতা তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করলেন। তারপর ভক্তগণ শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুরের অপ্রাকৃত শরীর নিয়ে মায়াপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। রাস্তা খারাপ হওয়ার জন্য গাড়িটি পরদিন সূর্যোদয়ের পূর্বে মায়াপুর পৌঁছালো। প্রথমে শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুরের শ্রীঅঙ্গ শ্রীচৈতন্য মঠে নিয়ে যাওয়া হল। ঠিক তখনই মঙ্গল আরতি শেষ হয়েছিল। শ্রীশ্রীগুরুগৌরাঙ্গ- গান্ধব্বিকা গিরিধারীর দর্শন করিয়ে, শ্রীল গৌর কিশোর দাস বাবাজী মহারাজের সমাধি এবং শ্রীল প্রভুপাদের সমাধিতে নিয়ে যাওয়া হল। শ্রীচৈতন্য মঠের ভক্তগণ শ্রীল প্রভুপাদের প্রসাদী মালা শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুরের শ্রীভাঙ্গে অর্পণ করলেন। তারপর মহাপ্রভুর জন্মস্থান যোগপীঠ মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। পূজারী মহাপ্রভুর প্রসাদী মালা গুরুদেবের শ্রীঅঙ্গে অর্পণ করলেন। সকল ভক্তবৃন্দ ক্রন্দন করতে লাগলেন কারণ এটা ছিল শ্রীল গুরুদেবের শেষ দর্শন। সমস্ত মঠের ভক্তগণ তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন এবং গুরুদেবের শ্রীঅঙ্গে মাল্যদান করেন। তারপর শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুরকে শ্রীচৈতন্য গৌড়ীয় মঠে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও ভক্তগণ প্রসাদী মালা অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শেষ পর্যন্ত, ভক্তগণ শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুরের শ্রীঅঙ্গ শ্রীগোপীনাথ গৌড়ীয় মঠে নিয়ে আসেন।
গুরুদেবকে শেষবার দর্শন করার জন্য অসংখ্য ভক্তগণ শ্রীগোপীনাথ গৌড়ীয় মঠে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুরের শ্রীঅঙ্গ শ্রীশ্রীরাধা-গোপীনাথকে পরিক্রমা করিয়ে নাটা মন্দিরে রাখা হয়। ভক্তগণের ক্রন্দন ধ্বনিতে এক হৃদয় বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি হল। গুরুদেবের বিরহে কাতর ভক্তগণ ক্রন্দনরত অবস্থায় হা গুরুদেব হা গুরুদেব। বলে আর্তনাদ করতে লাগলেন।
সকলে শ্রীল গুরুদেবের সমাধি কার্য সম্পন্ন করার জন্য শ্রীল ভক্তি বিজ্ঞান ভারতী মহারাজের জন্য আপেক্ষা করছিলেন। শ্রীল ভক্তি বল্লভ তীর্ণ গোস্বামী মহারাজ ওনাকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু শ্রীল ভারতী মহারাজের ফ্লাইট বিলম্বিত থাকায় শ্রীল ভক্তি সৰ্ব্বস্ব গোবিন্দ মহারাজ সমাধি কার্য শুরু করেন। ভক্তগণ সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন প্রকার আচার-নিয়ম পালন করতে থাকেন। পুরীর সমুদ্রের বালুকা ও জগন্নাথের প্রসাদী সমস্ত উপকরণ শ্রীল পুরী গোস্বামী ঠাকুরের সমাধিতে অর্পণ করা হয়। সমাধি কার্য সম্পন্ন হয় দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে বিভিন্ন মঠের আচার্যগণ সমাধি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
*লেখাটি শ্রীগৌরভক্ত চরিতামৃত থেকে সংকলিত। সংকলক - তানজুম সাকিব।