সাংস্কৃতিক উৎসব বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে • মোহাম্মদ শামছুজ্জামান


প্রতিবছরের মতো এবারও পহেলা বৈশাখ এবং মঙ্গল শোভাযাত্রা পালন নিয়ে বিতর্ক উঠে এসেছে। দেশের জনসাধারণের একাংশ এতে ভিন্ন ধর্মীয় উপাদানের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে যারপরনাই উদ্বিগ্ন এবং বিরোধিতায় নেমেছেন। এই সংশয় যে কতটুকু অবিমৃষ্যকারিতা তা বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পঠন-পাঠনের উপলব্দিতে তা জানাতে চাই। আসলে নতুন জাতি হিসেবে টিকে থাকার লড়াইয়ে সংস্কৃতিতে গ্রহন-বর্জনের ধারা জারী থাকার প্রয়োজনীয় অভিক্ষেপ কতটুকু হওয়া প্রয়োজন, তার আলাপ মাত্র।

পেশাজীবী হিসেবে জার্মান ভাষা শেখাসহ পশ্চিম জার্মানি ও বৃহত্তর জার্মানিতে পনের মাস অবস্থান কালীন সময়ে গভীর অভিনিবেশে তাদের ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতি উপলদ্ধি করেছিলাম। এখন সেই সময়ের স্মৃতিকথা ‘ভিদারজেহেন’ লিখছি। জার্মানদের প্রায় শতভাগ খ্রিস্টান, তবে অর্ধেকের বেশি ক্যাথলিক, বাকী প্রটেস্টান। সেমিটিক ধর্মের ধারক-বাহক হিসেবে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও কার্যক্রমে কোন উত্তাল তরঙ্গ নেই, তবে ক্রিসমাস-ডে উপলক্ষে অর্থনীতিতে বিরাট চাঙ্গাভাব আসে। আর কাছাকাছি সময়ে সামাজিক উৎসব নিউ ইয়ার হওয়াতে তারা উত্তাল হয়ে আনন্দে মাততে অপেক্ষায় থাকে। প্রত্যেক দেশ ও জাতির স্বতন্ত্র সামাজিক উৎসব থাকে, তা গড়ে ওঠে হাজার বছর ধরে। আর গড়তে সাহায্য করে তাদের ভাষা, কৃষি, শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থা ও আবহাওয়া; মোটেও ধর্মের ওপর নির্ভরশীল না। জার্মানদের এরূপ সামাজিক সাংস্কৃতিক উৎসবের নাম ‘অক্টোবর ফেস্ট’ বা অক্টোবর উৎসব। জার্মানরা তাদের প্রধান শস্য আঙুর মার্চ-এপ্রিলে চাষ করে এবং উৎপন্ন আঙ্গুর অক্টোবর মাসে তোলা হয়। সেই আঙ্গুরে তারা বাণিজ্যিক উৎপাদনে সাদা ও লাল ওয়াইন (অবশ্যই হুইস্কি না) তৈরী করতে শুরু করে। এই আঙ্গুর তোলার সময়ে তারা সামাজিক সংস্কৃতির অংশ হিসেবে নাচগানে মাতে, কোথাও কোথাও প্রথমদিন শোভাযাত্রা বের করে। অক্টোবর ফেস্ট ছোট থেকে বড় শহরে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে নভেম্বর পর্যন্ত চালু থাকে। জার্মানদের প্রদেশ ভিত্তিক কিছু ফেস্টিভাল চালু থাকে, তবে সেটা অক্টোবর মাসের মতো না। তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোয় বাণিজ্য বাড়ে, তবে পালনে নিরুত্তাপ।

এবার আসা যাক বাংলাদেশের বাঙালি জাতির দিকে, সিংহভাগ মুসলমান। দূর মরুদেশ, ঊষর-ধূসর আবহাওয়ার ধর্মীয় সংস্কৃতির আবরণ মিশেছে সবুজ শ্যামলিমায়। বাঙালি হাজার বছরের অনেক যাতনায় দু’বার ধর্ম পরিবর্তনে থিতু সাম্যের ইসলাম তলে। কিছুদিন আগে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন, আবার বিজাতীয় স্বধর্মীয়দের হাতে চরম অপমানিত হয়ে সর্বভৌমত্ত্ব অর্জন। এসব বেশিদিন আগের কথা না। পাশের বড়দেশ ভারত, হিন্দুত্ত্ব মৌলবাদের ডঙ্কা বাজিয়ে চলছে, মুসলিমরা বিভিন্ন কায়দায় নিষ্পেষিত, আবার মনু সংহিতার বিচারে দলিত বা শুদ্রদের অবস্থা তথৈবচ। এসব কারণে এখানে ভয় তো হতেই পারে সামাজিক জীবনে! এটাই বাস্তবতা। বাঙালি মুসলমান কখনোই সাম্প্রদায়িক না, তার রক্তে মিশে আছে ঐতিহাসিক ভয়-সংশয়। এই ভয়ের আবরণ সরাতে না পারলে মৌলবাদ জেঁকে বসে সব মানবিক গুণগুলো ধ্বংস করে দেবে।

সম্প্রতি ১৬০ বছর আগে কালীপ্রসন্ন সিংহের লেখা কোলকাতা শহুরে জীবনের উপন্যাস ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ পড়েছি। বিবেচ্য বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। ব্রিটিশ রাজের অধীনে সেই সময়ে স্থানীয় হিন্দু বাঙালি সমাজে পুঁজির বিকাশ এবং এলিট শ্রেণী তৈরী হয়েছিল, সেই সাথে হিন্দু কলেজ সংশ্লিষ্ট শিক্ষার প্রসার। পুঁজির ধর্মই তার প্রয়োজনে স্থানীয় ধর্মকে সাথে নিয়ে সামাজিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো। হুগলি জেলায় উদ্ভাবিত ‘বারোয়ারি পূজো’ কোলকাতায় নিজেদের উৎসবে এনে বসিয়ে উদযাপনের মাধ্যমে তা শুরু হয়েছিল। কারণ সবার জন্য আর কোন উন্মুক্ত উৎসবের প্রচলন ছিল না, দুর্গা পূজো ছিল উচ্চ জমিদার শ্রেণীর পারিবারিক উৎসব, সাধারণ হিন্দুদের, বিশেষকরে নিম্নবর্ণের জন্য নিষিদ্ধ । বারোয়ারি পূজো বেশিদিন টিকলো না। একটার পর একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যদিয়ে অবশেষে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের নাগালে আসলো দুর্গাপূজো এবং সকল শ্রেণী যাতে অংশগ্রহণ করতে পারে তার জন্য নাম দেয়া হলো ‘বারোয়ারি বা সর্বজনীন দুর্গা উৎসব’। এই সর্বজনীন করা হয়েছিল দলিত ও নিম্নবর্ণের হিন্দু প্রজাদের জন্য। কোলকাতা থেকে সেই মডেল গ্রাম-গঞ্জে আনা হয় উৎসব আকারে, মন্দির ঘিরে বাণিজ্যের মেলা। কিন্তু বাংলার সিংহভাগ হিন্দু জমিদারদের প্রজার বিশাল অংশ ছিল ‘নেড়ের বাচ্চা’, তাদের কাছে খাজনা আদায়ে তো কিছু একটা করা প্রয়োজন। বৈশ্যর প্রয়োজনে সর্বজনীনে নেড়েদের ঢুকাতে হলো বৈকি! এটাই ধর্মের বাস্তব ট্যুইস্ট! পুঁজিকে লালন করা।

এবার আসি বাঙালির বৈশাখে। ছোটবেলায় ঝিকরগাছাতে পহেলা বৈশাখে(১৯৬৬-৬৯সাল) আমাদের কিশোরকালে মোহনীয় দিন কাটতো, আব্বা ছিলেন মুদি দোকানদার। হালখাতায় দোকান সাজাতো, আর মিষ্টিমুখের ছড়াছড়ি। বাস্তবে অন্যকোন উৎসব ছিলনা। তাহলে, এই হালখাতার তাৎপর্য কি? অবিভক্ত বাংলার হাটে-বাজারে মুৎসুদ্দি-মহাজন ছিল প্রধানত সনাতন, তার খাদক প্রধানত দরিদ্র মুসলমান ও নিম্নবর্ণের সনাতন। খেরো খাতায় লেখা থাকতো বৎসরের জমে থাকা বাকী, যা আমন ও কেতেন ফসল উঠলে বাকী টাকা উঠাতে সুবিধা হতো। পহেলা বৈশাখ প্রচলনের সাথে আবার বাদশা আকবরের নামও জড়িত। সুতরাং এটা বলা যায়, পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সর্বজনীনতার সাথে কোন ধর্মের সংশ্রব নেই। ছিল অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্টতা। হয়তো এখন তার প্রয়োজন নেই।

কিন্তু নবীণ জাতির সাংস্কৃতিক উৎসব প্রয়োজন, নতুন রক্তে নতুন স্বপ্ন বয়ে আনবে, এটাই স্বাভাবিক। আগেই বলেছি, দুর্গা উৎসব সর্বজনীন না, একটি সম্প্রদায়ের সকল বর্ণ-শ্রেণীর জন্য, মুসলমানও যেতে পারে, দোষের কিছু নেই। তাহলে বাংলাদেশের বাঙালি জাতির সর্বজনীন সামাজিক উৎসব কি থাকলো? ইদ-পূজো তো সম্প্রদায়ের জন্য। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পহেলা বৈশাখ উৎসব বিশাল রেভিনিউ যোগান দেয়, গ্রাম-গঞ্জের ব্যবসা রমরমা হয়ে উঠে। কেউ হয়তো বলবেন পহেলা বৈশাখ সনাতনদের চৈত্র সংক্রান্ত্রির সাথে জড়িত। আমরা কেন তা ভাববো! আমরা তো নেড়ের জাত অর্থাৎ সর্বশেষ বৌদ্ধধর্ম জাত।

আমাদের মনে ভয়-সংশয়ের দোলাচল দূর করতে হবে। আর মুখোশ কেন অপাংক্তেয় হবে? বিষণ্নতার ঘোরে, আবার সব সময় আশপাশে কি আমরা জীবজন্ত দেখি না! যদি কোন মুখোশ বা প্রতিকৃতি সনাতন ধর্ম সংশ্লিষ্ট হয়, তা উদযাপনে নিয়োজিতরা পরিহার করবেন। মনে রাখতে হবে, সংস্কৃতির উপাদান পরিবর্তনশীল, দেয়া-নেয়ার মতো। ইসলাম হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে টোকা মাথায় নেংটি পরে বাংলার অন্ত্যজ শ্রেণীর রক্তে-ঘামে মিশেছে, মরুর বুকের জোব্বা পরে না। প্রয়োজনে ধান কাটার সময় পৌষমাসে আরেকটি সর্বজনীন উৎসব চালু করা যেতে পারে। কারণ বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে রাখতে হবে। কোন জাতি জেগে থাকে নিজস্ব সংস্কৃতির মাঝে, সম্প্রদায়ের চেতনায় ঘুমালে ভেদবুদ্ধি লোপ পেয়ে জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ রেলওয়ে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

ট্যাগ সমূহ

ঝিকরগাছার ইতিহাস, ঝিকরগাছা উপজেলার ইউনিয়ন, ঝিকরগাছা খবর, গদখালি ঝিকরগাছা, ঝিকরগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান, ঝিকরগাছা পোস্ট কোড, ঝিকরগাছা এমপি, ঝিকরগাছা আবহাওয়া, ঝিকরগাছা উপজেলা ম্যাপ, ঝিকগাছার ঐতিহ্য, পানিসারা, ঝিকরগাছা পৌরসভা, ঝিকরগাছা দর্শনীয় স্থান, ঝিকরগাছা বাজার।