আত্মহত্যা একটি মানসিক ব্যাধি যা কিনা সব বয়সের মানুষেরই হতে পারে। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায় কোনো কোনো জ্ঞানী ব্যক্তিও বেছে নিয়েছেন আত্মহত্যার পথ। এটা এমন এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষ স্ব-ইচ্ছায় মৃত্যুবরণ করে। যে জীবনটা মানুষের এত প্রিয়, যে জীবনটার জন্য এত ছুটে চলা সেই জীবনটাকে নিজের হাতে শেষ করা মানসিক ব্যাধি ছাড়া আর কিছুই নয়।
সন্তানকে আদর ও স্বাধীনতা দেয়ার নামে আমরা যখন শাসন বারণের শৃঙ্খলাটা আলগা করলাম সন্তান তখন উশৃংখল হয়ে উঠলো। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সন্তানকে গড়ে তুলতে যেয়ে আমরা বোকা অভিভাবকরা সন্তানের মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতার বীজ বপন করলাম।
গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে। আর ২০ লাখ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। প্রতিবছর আমাদের এই বাংলাদেশেও অসংখ্য মানুষ এই মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হয়ে নিজেকে ঠেলে দিচ্ছে আত্মহত্যার দিকে। কেউ বেঁচে উঠছে, কেউবা ছেড়ে যাচ্ছে পৃথিবী। বর্তমান সময়ে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেকগুণ বেড়ে গেছে বিশেষ করে বয়সন্ধিকালের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে। সামান্য কারণ, সামান্য অভিমান থেকেও ঘটে যাচ্ছে এমন ভয়ানক দুর্ঘটনা।
আত্মহত্যাকে ‘না’ বলা অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আত্মহত্যা যে কোন পরিবারের জন্যই ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। একজন প্রিয় মানুষের আত্মহত্যায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে পরিবারের সদস্যরা। পাশাপাশি সহ্য করতে হয় মানুষের কটু কথা ও পুলিশের ঝামেলা। গ্রাম, মফস্বল, ছোট শহর থেকে বড় শহর, রাজধানী সবখানে একই চিত্র। দরিদ্র অভাবী মানুষ, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত, অশিক্ষিত সব শ্রেণীতেই বয়সন্ধিকালের ছেলেমেয়েরা একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। বিভিন্ন কারণে এইসব অভিমানে শিশুরা ঝুলে পড়ছে গলায় কাপড় বা দড়ি দিয়ে। বাবা-মা বকলে, মারলে বা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কাজ করতে বললে ঘটে যাচ্ছে অঘটন। প্রেম জনিত সমস্যাও প্রকট। এখন আমাদেরকে জানতে হবে ছেলেমেয়েরা কেন এত অভিমানী হচ্ছে? একটা সময় ছিল যখন বাবা মায়ের কড়া শাসনে বড় হতো ছেলে মেয়েরা। বাবা মার পিটানিতে হাত-পায়ে কোথাও কেটে গেলেও চোখ তুলে কথা বলত না তারা। খুব বেশি অভিমান দুঃখ আর রাগ হলে বন্ধুর বাড়িতে যেয়ে কিছুক্ষণ থেকে আসতো। কড়া শাসনের মাঝখান থেকে যেটুকু তাদের ভালোবাসা পেতো সেটুকুই ভুলিয়ে দিত সব অভিমান। কড়া শাসনটা শিশুর জন্য প্রযোজ্য নয়। এই কথাটা যখন আমরা শুনলাম তখন থেকেই বুঝতে ভুল করলাম। আমরা ভাবলাম সন্তানকে বুঝি শাসন দেওয়াই যাবে না। সন্তানকে আদর ও স্বাধীনতা দেয়ার নামে আমরা যখন শাসন বারণের শৃঙ্খলাটা আলগা করলাম সন্তান তখন উশৃংখল হয়ে উঠলো। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সন্তানকে গড়ে তুলতে যেয়ে আমরা বোকা অভিভাবকরা সন্তানের মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতার বীজ বপন করলাম। ফলে যেটা হলো সন্তানরা বাবা-মার মুখের উপর তর্ক করতে শিখলো। কথায় কথায় রাগ করে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকা; বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া—এ যেন ঘরে ঘরে স্বাভাবিক বিষয় হয়ে উঠলো। ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার শিশুদের করে তুললো আরো বেশি ইচড়ে পাকা। বয়সন্ধিকালের ভয়ানক যে সময়টা (১৩-১৬ বছর) এই সময়টাতে শিশুর হাতে নিজস্ব মোবাইল দেওয়া যে কতটা ভয়ংকর তা কিছু অভিভাবক বুঝেও বুঝছে না। আমাদের ভুলের জন্য আমাদের সন্তানরা সঠিকভাবে গড়ে উঠছে না। তাই এই অঘটন ঘটেই চলেছে। ২০২৩ এর এই চার মাসে বেশ কিছু কচি প্রাণ ঝরে গেছে এই মানসিক রোগে। বিভিন্ন ছোট ছোট কারণে এরা ঝরে গেল। স্কুলের শিক্ষক মেরেছে, বাড়ি এসে মার শাড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ল। ভাই বোন ঝগড়া করেছে, বোনকে শাস্তি দিতে বোনের ওড়না দিয়ে ফ্যানে ঝুলে পড়লো। বড় বড় চুল বাবা-মা কাটতে বলেছে কিন্তু ছেলে কাটবে না। এটা তাদের স্টাইল। বাবা জোর করে সেলুনে নিয়ে চুল কেটে দিল। বেশ! বাড়িতে এসে ছেলে ঝুলে পড়লো ফ্যানে। আরো একটি ভয়ানক ব্যাপার স্যোশাল মিডিয়ায় ঘুরতে দেখা যাচ্ছে—লাইভ আত্মহত্যা। এটা ইন্টারনেটের কুফল। বলা বাহুল্য ইন্টারনেটের সুফল এর চাইতে কুফলেই আমাদের আকর্ষণ বেশি।
বর্তমান সমাজে ব্রেকআপ বলে একটি শব্দ প্রচলিত হয়েছে। ছেলেমেয়েরা প্রেম করছে আর সম্পর্কে ভেঙ্গে বলছে ব্রেকআপ হয়েছে। সকালে প্রেম হলে বিকালে ব্রেকআপ, শনিবারে প্রেম হলে রবিবারে ব্রেকআপ। এই যে ব্রেকআপ ব্রেকআপ খেলা এরই জের ধরে হারিয়ে গেছে অসংখ্য প্রাণ। কেউবা আত্মহত্যা করছে কেউবা অন্যকে হত্যা করছে। কিছুদিন পূর্বে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি একটি মেয়েকে রাস্তায় কুপিয়ে মারা হয়েছে। জানা গেছে যে তিনটি ছেলে কুপিয়েছে তারা সবাই মেয়েটির ব্রেকআপ হওয়া বন্ধু ছিলো। সম্প্রতি ঝিকরগাছায় বি এম হাই স্কুলের ক্লাস সেভেনে পড়া একটি মেয়ে শ্লীলতাহানির পর আত্মহত্যা করলো। জানা গেছে এখানেও প্রেমঘটিত ব্যাপার।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রথমে দরকার মানসিক চিকিৎসা। তার মানে এই নয় যে মানসিক ডাক্তার দেখাতেই হবে। মানুষের চিকিৎসা শুরু হয় পরিবার থেকে। পরিবারের শিক্ষা প্রধান মানসিক বিকাশ ঘটায়। বাবা-মা যেমন শাসন করবে তেমন বন্ধু হয়েও পাশে থাকবে। বিশেষ করে মাকে হতে হবে সন্তানের প্রিয় বন্ধু। সন্তান যেন মন খুলে মাকে সব কথা বলতে পারে। পরিবারের বন্ধন যদি দৃঢ় হয় সন্তান ঠুনকো সম্পর্কের আশায় ছুটবে না। পরিবারে যদি আনন্দ থাকে সন্তান বাহ্যিক আনন্দে মশগুল হবে না। পরিবারে থাকা প্রয়োজন ধর্মীয় চেতনাবোধ। ধর্মীয় গোঁড়ামি করে যেমন সন্তানকে ঘরে আটকে রাখা যাবে না তেমনি আধুনিকতার নামে সন্তানকে অশালীন পোশাক পরিয়ে বাইরে বের করাও ঠিক হবে না। চাওয়ার সাথে সাথেই দেয়া যাবে না তার চাওয়ার দ্রব্যটি। আগে তাকে বোঝাতে হবে দ্রব্যটির প্রয়োজনীয়তা কতটা। সংসারে সুখ-দুঃখ, সুবিধা-অসুবিধা এবং পথচলা নিয়ে সন্তানের সাথে পারিবারিক আলোচনা করতে হবে। সন্তান বুঝবে পরিবারে তার সম্মান রয়েছে।
আজকের সময়ে বাবা ছুটছে বাবার মত, মা ছুটছে মার মত আর সন্তান হাওয়াই ভাসছে নিজের মত। একে অপরের বন্ধু হয়ে পাশে না থেকে সবার পৃথক পৃথক বন্ধু হয়ে পাশে রয়েছে মোবাইল ফোনটি। আসুন সন্তানের মানসিক বিকাশে সচেতন হই। তাকে আনন্দ দিয়ে বাঁচতে সহায়তা করি। সন্তানের মন খারাপের বন্ধু হয়ে পাশে থেকে সকল সমস্যার সমাধান করি। আমরা বাবা-মায়েরা হয়ে উঠি সন্তানের সবচেয়ে বড় মানসিক ডাক্তার। রক্ষা পাক আমাদের সন্তানেরা।