কোম্পানী আমলে যশোরের ইতিহাস |
বাংলার স্বাধীনতা সূর্য ১৭৫৭ সনে পলাশীর আম্রকাননে অস্তমিত হয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর বাংলার মসনদে উপবিষ্ট হন। বাংলাদেশে তখন নবাবী আমলের শাসনব্যবস্থা ইংরেজ প্রভুদের ইচ্ছায় একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিল। মীরজাফর নামমাত্র নবাব থাকায় চারদিকে দেখা দিয়েছিল ঘোর অরাজকতা। ইংরেজ প্রভুরা দেশ শাসনের নামে মীর জাফরের মতো একজন অকর্মণ্য ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসিয়ে ব্যাপকভাবে বাংলাদেশের উপর অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাতে থাকে। মীরজাফর বেশীদিন ইংরেজ বেনীয়াদের মনোরঞ্জন করতে পারলেন না। কোষাগারের বিপুল অর্থ সম্পদ তাদের পদ সেবায় নিয়োজিত করেও তাদের মন উঠলো না, তখন তাকে গদিচ্যুত করে মীর কাশিমকে নবাবী তত্ত্বে বসিয়ে পলাশীর কৃতজ্ঞতা পরিশোধ করলেন। মীর কাশিম সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়েই ইংরেজদের সেবায়েত হয়ে থাকতে রাজি হলেন না। তার ফলে দেখা দিল যুদ্ধবিগ্রহ। অবশেষে উদয়নালার যুদ্ধে চরমভাবে পরাজিত হয়ে পলায়ন করলেন। বাংলার সিংহাসনে আবার ডাক পড়লো অহিফেন সেবী, কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত অথর্ব মীরজাফরের। কিছুদিন পরই তার মৃত্যু হয়। তারপর বাংলার সিংহাসনে পুতুলের ন্যায় কতজন যে নবাব হলেন, তার ইয়াত্তা নেই।দিল্লীর বাদশাহ শাহ আলমের নিকট থেকে ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী গ্রহণ করেন। দেশের শাসন ব্যবস্থা তখন একেবারে বদলে গেছে। ইংরেজরা রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে প্রজাদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে লাগলো। প্রজারা ক্রমান্বয়ে নিঃস্ব ও নিরন্ন হয়ে পড়লো। একদিকে ইংরেজদের রাজস্ব আদায়ের কড়াকাড়ি, অন্যদিকে দস্যু তস্করের উৎপাত।
১৭৬৯ খৃষ্টাব্দে বাংলায় মন্বন্তর দেখা দিল। এই নিদারুণ দুর্ভিক্ষের প্রকোপে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এর পরে ভারত শাসনের উপর ভিত্তি করে বিলাতের কর্তৃপক্ষেরা এক নতুন বিধান রচনা করে ওয়ারেন হেস্টিংসকে বাংলার গভর্নর করে পাঠান। ১৭৭২ খৃষ্টাব্দে মুর্শীদাবাদে আর দেওয়ানী অফিস রইলো না। ইংরেজ প্রতিষ্ঠিত কলকাতায় তা স্থানান্তর করা হল। বাংলার গভর্ণর হেস্টিংস রাজস্ব আদায়ের জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে কালেক্টর নিযুক্ত করেন। যশোরেও এই সময় কালেক্টর নিযুক্ত করা হয়। যশোর শহরের পূর্বদিকে অবস্থিত প্রাচীন মুরলী নগরীতে তার দফতর স্থাপিত হয়। পরে এই ব্যবস্থা রদবদল করার ফলে কালেক্টর প্রথা উঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৭৮১ খৃষ্টাব্দে ভারত শাসনের নতুন বিধি অনুসারে যশোরে টিলম্যান হেঙ্কেল নামক একজন ইংরেজকে জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট করে পাঠানো হয়। মুবলীতে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি আদালত। যশোর, ফরিদপুর ও খুলনার অধিকাংশ অঞ্চল তার অধীনে ছিল। তার সহকারী ছিলেন রিচার্ড। মুরলীর একটি প্রাচীন বাড়ি সংস্কার সাধন করে তাদের বাসস্থানের জন্য ব্যবহৃত হয়।
পূর্বে অপরাধীদের দমনের জন্য মুরলীতে ও ভূষণায় একজন করে দারোগা থাকতো। তাদেরকে বলা হ'ত থানাদার। নবনিযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেট এই বিভাগেও ভারপ্রাপ্ত হলেন। কিন্তু আইনগত পূর্ব প্রথানুযায়ী ছিলেন দারোগারা মুর্শীদাবাদের নবাবের অধীনে। তখনো পর্যন্ত ফৌজদারী কার্যভার কোম্পানীর হস্তগত হয় নাই। অপরাধীকে কারাগারে দেওয়া এবং মামলা বিষয়ক কাগজ পত্র দারোগার কাছেই থাকতো। নায়েব নাজিম বা নবাব এদের উপর যে হুকুম জারি করতেন, তা ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমেই যেত। এই দ্বৈত শাসনের ফলে ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুম মানা বা না মানা দারোগাদের ইচ্ছার ব্যাপার ছিল।
পূর্বে সমগ্র যশোর অঞ্চলে ৪টি থানা ছিল ভূষণা, মীর্জা নগর, খুলনার নয়াবান ও যশোরের কেশবপুরের কাছে ধরমপুরে ছিল এই থানাগুলি অবস্থিত। হেঙ্কেল ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে এসেই প্রত্যেক থানায় দেশী বরকন্দাজ না রেখে বিদেশী সিপাহী রাখবার প্রস্তাব করেন। সে প্রস্তাব মঞ্জুর হলে মুরলীতে ৫০ জন, মীর্জা নগরে এবং ভূষণায় ৩০ জন এবং ধরমপুরে ৪ জন বিদেশী সিপাহী নিয়োগ করা হয়। খুলনায় নয়াবাদে বিদেশী সিপাহী নিয়োগ করা হলো না।
এই প্রথা কোম্পানীর নিকট ব্যয়বহুল মনে হওয়ায় ১৭৮২ খৃষ্টাব্দে বিলোপ করে দেওয়া হয়। দেশে শান্তি, শৃঙ্খলা রক্ষা ও চুরি-ডাকাতি যাতে না হয়. তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করবার জন্য জমিদার ও তালুকদারদের উপর কোম্পানী সরকার এক ইস্তেহার জারি করেন। এই ইস্তেহারে ছিল- চুরি, ডাকাতি, খুন প্রভৃতি রোধ করবার জন্যে ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ মতো স্থানে স্থানে থানা রাখতে হবে। প্রজার চরিত্রের জন্য জমিদার ও তালুকদার দায়ী হবেন। যদি চুরি ও ডাকাতি হয়, প্রজার ক্ষতিপূরণ জমিদারকে করতে হবে। এসব আইন পালন করে দেশের মধ্যে শান্তিরক্ষা করতে না পারলে তাদেরকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
এই ইস্তেহারের ফলে জমিদারেরা শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। যশোর ভূ-খণ্ডে ৪টি থানার স্থলে ১৩টি থানা স্থাপিত হয়। তার মধ্যে খুলনার নয়াবাদ ও যশোরের ঝিনাইদহ থানা সরকারের কর্তৃত্বে রইলো। কোম্পানী সরকারের এতো কড়াকড়ি সত্ত্বেও দেশের মধ্যে চুরি-ডাকাতি ও রাহাজানি লাগলো। কিন্তু ইস্তেহার মোতাবেক কোনো শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো না। কিছুদিন পরে সম্পূর্ণ ব্যবস্থা একেবারে পণ্ড হয়ে যায়।
হেঙ্কেল সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারক হওয়া সত্ত্বেও, তার কিছু করবার ছিল না। অপরাধের জন্যে আসামী ধৃত হলে পূর্ব প্রথানুযায়ী বিচার করতেন দারোগা। দারেগার কাজে বাধা দেবার তার কোন ক্ষমতা ছিল না। দারোগা ছিলেন নিজামের লোক কোম্পানীর নহে। এই দ্বৈত শাসনের ফলে দেশে শান্তি বলতে কিছুই ছিল না। দারোগারা বিচারের নামে প্রহসন সৃষ্টি করে নিজেদের মর্জিমত অপরাধীর সাজা দিতেন।
সারা দেশে দস্যু তস্করে ভরে গিয়েছিল। জমিদার ও তালুকদারেরাও লুটতরাজ করে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করতেন। ১৭৮৩ খৃষ্টাব্দে ভূষণা থেকে ৪০,০০০ টাকা কলকাতায় নিয়ে যাবার পথে, তিন হাজার লোক আক্রমণ করে লুটপাত করে নেয়। নড়াইলের জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা কালীশঙ্কর রায়ও এহেন কার্য করতেন। একবার তিনি একখানি বৃহৎ চাউলের নৌকা লুট করেন। কলকাতায় এ ব্যাপারে তিনি ধরা পড়লে তাকে ৪০ জন পাহারাদার সহ মুবলীৰ হাজতে আনা হয়েছিল। এ সম্বন্ধে যশোরের ইতিহাস প্রণেতা West Land তার 'Report on the Jessore' গ্রন্থে লিখেছেন যে, Kalisankar was a man of wonderful energy and ability in business-my regard for truth compels me to say it-he was perfectly unscrupulous. (West Land, Jessore, P. 157, see also. Hunter, Jessore, P-217).
হেঙ্কেল সাহেব কালী শঙ্কর ও তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা নন্দকিশোরকে ধরবার জন্য কুতুব উল্লা সর্দারের অধীনে কতগুলি সিপাহীকে নড়াইলে পাঠিয়েছিলেন। তার সাথে কালী শঙ্করের ১৫০০ লাঠিয়ালের এক সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে সরকার পক্ষে ২ জন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়েছিল। কুতুৰ উল্লা সর্দার নিজেও আহত হয়েছিল। হেঙ্কেল সাহেবের নিকট এ খবর পৌঁছলে তিনি পুনরায় অতিরিক্ত সৈন্যদল পাঠিয়েছিলেন। তাতে নন্দকিশোর ধৃত হন এবং কালী শঙ্কর নাটোর অভিমুখে পলায়ন করেন। পরে সেখান থেকে কলকাতায় চলে গেলে সরকারের প্রচেষ্টায় ধরা পড়েন। তার সম্বন্ধে West Land বলেছেন যে, A dacoit and a notorious disturber of peace.' তাকে মুরলীতে আনার পর দারোগার বিচারে তিনি বেকসুর খালাস পান ।
১৭৮১ খৃষ্টাব্দে যশোর একটি পৃথক জেলা রূপে পরিণত হয়। এটিই হচ্ছে বাংলার প্রথম জেলা। এই জেলা গঠিত হয়েছিল ইশপপুর ও সৈয়দপুর পরগনার সমন্বয়ে । পরে ১৭৮৭ খৃষ্টাব্দে মামুদশাহী পরগনা যুক্ত হয়। ১৭৯৩ খৃষ্টাব্দে নলদী সমেত ভূষণা বিভাগ যশোরের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল। হেঙ্কল সাহেবের আমলে মুরলী ছিল জেলার সদর স্টেশন। ১৭৮৯ খৃষ্টাব্দে তিনি বদলী হয়ে গেলে রোক সাহেব তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি মুরলী থেকে পার্শ্ববর্তী সাহেবগঞ্জে দফতর স্থানান্তর করেন। চাঁচড়ার রাজারা এই দফতর তৈরির জন্য ৫০০ বিঘা জমি সরকারকে দান করেছিলেন।
ভূষণা ১৭৯৩ খৃষ্টাব্দে যশোরে অন্তর্ভুক্ত হলে রাজস্ব সংগ্রহের ভার যশোরের কালেক্টরের উপর পড়ে। মহম্মদপুর কেন্দ্রস্থান বলে সেখানে ১৭৯৫ খৃষ্টাব্দে যশোরের সদর দফতর উঠিয়ে নিয়ে যাবার প্রস্তাব হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা সম্ভব হয় নাই।
১৮৪৫ খৃষ্টাব্দে মাগুরা মহকুমা স্থাপিত হয়। এই স্থানে পূর্বে মগ ও ফিরিঙ্গি দস্যুদের উৎপাত ছিল। ধর্মদাস নামক জনৈক মগ আরাকান থেকে এসে গড়াই নদীর কূলে খুলুম বাড়ি প্রভৃতি মৌজা দখল করে নিয়েছিল। লোকে তাকে “মগ জায়গীর” বলতো। আওরঙ্গজেবের আমলে ধৃত হয়ে তিনি মুসলমান ধর্ম গ্রহন করতে বাধ্য হন। পরবর্তীকালে তার নাম হয় নিজাম শাহ । ইংরেজ আমলেও এখানে দস্যু তস্করের উৎপাত বৃদ্ধি পাবার ফলে, তা দমন করার জন্য একটি মহকুমা সৃষ্টি করা হয়। এই মহকুমার প্রথম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ককবার্ণ সাহেব।
১৭৮৬ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত মামুদশাহীর তহশীল কাছারি ছিল ঝিনাইদহতে। ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় এখানে ভূষণার অধীন একটি চৌকি সৃষ্টি করা হয়েছিল। ১৭৯৩ খৃষ্টাব্দে দেশে শান্তি রক্ষার জন্যে ঝিনাইদহে একটি থানা স্থাপন করা হয়। যশোর জেলায় যখন নীল বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করে, তখন মহকুমা প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে (১৮৬২)। ঝিনাইদহের শেষ কালেক্টর ছিলেন শেরবর্ণ সাহেব।
১৮৬১ খৃষ্টাব্দে নড়াইল মহকুমা হয়। প্রথমতঃ ফরিদপুরের অন্তর্গত গোপালগঞ্জে এই মহকুমার স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল। পরে সেখান থেকে ক্রমান্বয়ে ভাটিয়াপাড়া, লোহাগড়া ও কুমারগঞ্জে, অবশেষে নড়াইলে স্থাপন করা হয়।
প্রকৃতপক্ষে যশোর ভূখণ্ডে ১৭৮১ খৃষ্টাব্দে ইংরেজদের শাসনকার্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঐ বছরই মুরলীতে আদালত ভবন নির্মাণ করা হয়। তার পূর্বে ইংরেজরা কেবল রাজস্ব আদায় ছাড়া অন্য কিছু করতেন না। ১৭৯৩ খৃষ্টাব্দে জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ পৃথকীকরণ করা হয়।