গল্প • হৈবতের ট্রাক • সফিয়ার রহমান

 

হৈবতের ট্রাক - গল্প

অবিভক্ত ভারতের শেষের দিকে কলকাতার পাট ব্যবসায়ীরা এক নামে হৈবত গাড়োয়ানকে চিনতো। পৈতৃকসূত্রে পাওয়া অনাবাদী জমির থেকেও জোয়ান তাগড়া এক জোড়া এঁড়ে গরু ছিল তার প্রিয়। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের বোঝা মাথায় পড়ল। উঠতি যুবক বয়সেই ঝিম ধরে গেল। কুবাদ মোড়ল ব্যাপারটা আঁচ করে একদিন কাছে ডেকে পরামর্শ দিল- হ্যারে হৈবত গরু আছে, গাড়ি বানা। ঝিকরগাছা মোকাম থেকে পাট নিয়ে কলকাতার আড়তে যা। ভাল ভাড়া পাবি সংসারও চলবে ট্যাকে টাকাও জমবে। হৈবতের মাথা চট করে পাতলা হয়ে গেল। শরীরটা ঝিন ঝিন করে উঠল। কুবাদ চাচার কথাই আশির্বাদ মনে করে এ কাজে নেমে পড়ল। সপ্তাহে দুই তিনবার ঝিকরগাছা-কলকাতা আপ ডাউন করে ভালই আয় হতে লাগল। কলকাতায় লক্ষ্মীদির হোটেলের চিড়া দই-এ যেন মধুর স্বাদ। লক্ষীদির হাসিটাও চমৎকার। ক্ষুধা না লাগলেও খেতে যেতে ইচ্ছা করে। এ সুখ বেশিদিন সইলো না। ভারত বিভক্ত হয়ে গেল। এখন ঝিকরগাছার পাট যায় নওয়াপাড়ার মোকামে। হৈবতের গরুর গাড়ী দিক বদলিয়ে এখন যায় নওয়াপাড়ায়। লক্ষ্মীদির হোটেল এখানে নেই। আছে সাজ্জাতের হোটেল, লোকটা ভারী বজ্জাত। হেই গারোয়ান; হেই গারোয়ান বলে ডাক দেয়। দই চিড়া পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় গরম ভাত আর ইলিশ মাছের ঝোল। মুখ রোচক কিন্তু হৈবতের মন ভরে না। সম্প্রতি রাস্তায় ট্রাক চলতে শুরু করেছে। সাজ্জাত ট্রাক ড্রাইভারদের খুব সমীহ করে। ড্রাইভার দেখলেই বলে, ‘আইয়েন ছার; আইয়েন ছার। গরম খাওন আছিল। জলদি খাইয়া লন।’

গরু গাড়ী বাড়িতে পড়ে আছে হৈবতকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাপ মরা হৈবতকে খুঁজতে হৈবতের মার মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম, পাড়া প্রতিবেশিরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। কারন হৈবতের মা সময় নেই ক্ষণ নেই ভাঙ্গা কাঁসর গলায় ও...রে... আমার হৈবতরে...বলে কান্না শুরু করে। এ কান্নায় করুনা জাগে না, বড়ই বিরক্ত লাগে। পাড়ার বুড়িয়া কানে কম শোনে তারা এসে তেল পানি ফ্যানায়ে মাথায় দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে। দিন যায়, মাস যায়, বছরের মাথায় এক রাতে হৈবত ট্রাক চালিয়ে বাড়ি এল। গম্ভীর গলায় মা মা বলে ডাক দিল। মা লম্প ধরিয়ে উঠানে এসেই চোখ চরকগাছ। তাগড়াই গোঁফ, মুখ ভর্তি দাড়ি, মাথায় পাগড়ি। যেন শিখ এর বংশধর। এ বিটা আবার কিডা। মাথার ঘুমটা টানতে যাবে এমন সময় হৈব মাকে জড়িয়ে ধরল। সকাল বেলা বাড়ির উঠন গ্রামের ছেলে মেয়ে এসে ভরে গেছে। সবাই অপলক দৃষ্টিতে ট্রাক দেখছে, ট্রাকের গায়ে হাত দিচ্ছে কিন্তু উপরে উঠতে সাহস পাচ্ছে না। হৈ চৈ চেচাঁমেচিতে হৈবতের ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে আসতেই শিশুরা ভয়ে দৌড় দেওয়ার উপক্রম। হৈবত থামিয়ে সবাইকে ট্রাকে উঠতে বলল। হে হে শব্দ করে মূহুর্তেই ট্রাক ভর্তি হয়ে গেল। হৈবত ট্রাক চালিয়ে ঝিকরগাছা বাজারে এক পাক দিল। শিশুরা জন্মের পর এই প্রথম একটা বিমল আনন্দ উপভোগ করল।

হৈবতের বয়স হয়েছে, গাড়োয়ান থেকে এখন সে ড্রাইভার। সামান্য কারনে নওয়াপাড়া বাজারের মধ্যে ট্রাক মালিক তাকে দাড়ি ধরে মুখে চড়ালো। রাগে, ক্ষোভে, অপমানে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে এল। আর মনে মনে সাথে করে নিয়ে এল একটা সংকল্প। সে যে করেই হোক একটা ট্রাকের মালিক হবে। ইতঃমধ্যে খুলনায় ই¯্রাফিল মাওলানার একটা ট্রাক বিক্রি হবে। দামও বেশ সস্তা। ট্রাকটা সে কিনবে। গরু ছাগল হাঁস মুরগিসহ পাঁচ বিঘা জমি বিক্রি করে হৈবত ট্রাক মালিক হয়ে গেল। ট্রাক মালিক হৈবতের বিয়ের বাজার চড়া, এক সপ্তাহ না ঘুরতেই বিয়ে হয়ে গেল। হৈবতের সুখের সংসার কিন্তু ফল্গু ধারার মত একটা অসুখ তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ট্রাক চালিয়ে যা আয় হয় তার চেয়েও ব্যয় বেশি। আজ এ যন্ত্রাংশ ভাঙ্গে তো কাল ও যন্ত্রাংশ ভাঙ্গে। তেল খায় মাত্রাতিরিক্ত। সব চেয়ে বিরক্তিকর সহজে ষ্ট্রাট হয় না। কিছু দূর ঠেললে তারপর ঘ্রাত শব্দ করে ষ্ট্রার্ট হয়। পথের মানুষ জড়ো করে ঠেলাঠেলি হৈবতের আর ভাল লাগে না। মেজাজটা ইদানিং তিরিক্ষি হয়ে গেছে। ভাল কথাও ভাল লাগে না। চুল দাড়ি কেঁটে ছেঁটে হালকা হয়েছে কিন্তু মগজ গরম কমছে না। হৈবতের বাড়ির সামনে বড় আমগাছটার নিচে ট্রাকটা দীর্ঘদিন পড়ে আছে। এলাকার সব মিস্ত্রি ফেল। কেউ ভাল করতে পারল না। অবশেষে ঢাকা থেকে মিস্ত্রি এসেছে। সাতদিন যাবৎ মেরামত হচ্ছে আশপাশের মানুষ কাজ ফেলে বসে বসে দেখছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভীড়ে মিস্ত্রিরা ঠিকমত কাজও করতে পারছে না। ট্রাক মেরামতের সাথে সাথে হৈবতের মনটাও ধীরে ধীরে ভাল হচ্ছে। হৈবত একদিন শিশুদের উদ্দেশ্যে বলল, “তোমরা ট্রাকের কাছে আসবা না। দূরে দূরে থাক। ট্রাক ঠিক হয়ে গেলে তোমাদের নিয়ে সারা বাজার ঘুরব।” শিশুরা শুনে আনন্দে নেচে উঠল। কেউ আর ট্রাকের কাছে আসে না। হেড মিস্ত্রি বলল, ‘ট্রাক ঠিক হয়ে গেছ। এখন প্রথমে ঠেলে ষ্ট্রার্ট করতে হবে। পরে ঠিক হয়ে যাবে।’ কথামত তাই করা হল। ট্রাক ভর্তি শিশুরা আনন্দ করছে। কিছু দূর যাওয়ার পর সব তেল শেষ, ইঞ্জিন বাষ্ট হয়ে ধোয়াঁ ধোয়াঁ হয়ে গেল। ট্রাক থেকে লাফিয়ে যে যেমনি পারে দৌড়ে পালাল। হৈবতের থেকেও মিস্ত্রিদের মুখ শুকিয়ে চুন। একি হল! বছর গড়িয়ে গেল ট্রাক আমতলায় পড়ে আছে। পাড়ার শিশুদের বিনোদনের একটিই জায়গা, ঐ ট্রাকে চড়া। পথচারীরা শিশুদের উদ্দেশ্যে বলে, ‘ট্রাকে বসে আছিস কেন? ট্রাক চালাও।’ শিশুরা বলে, ‘এ ট্রাক না ঠেললে চলে না। ঠেলে দাও চালাচ্ছি।’ ঢাকার পার্টির কাছে হৈবত ট্রাকটা বিক্রি করে দিল। ট্রাকের পার্সগুলো খুলে খুলে অন্য ট্রাকে বোঝাই হচ্ছে। শিশুরা বসে বসে দেখছে। তাদের মুখটা অন্ধকার। কয়দিন পরে জায়গাটা ফাঁকা হয়ে যাবে। এখানে ড্রাইভার ড্রাইভার খেলা বন্ধ হয়ে যাবে।

পাড়ার দীন আলি মাষ্টার পন্ডিত মানুষ। তার একমাত্র ছেলেটি বড্ড বদ। প্রতি সন্ধ্যায় এক বেলা দাঁতের উপর না ভাজলে পড়তে বসে না। এক সন্ধ্যায় ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গেল কোথায়? দীন আলি মাষ্টার খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখে ছেলে হৈবতের ট্রাকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আজ ট্রাক আমতলা ছেড়ে ঢাকায় চলে যাচ্ছে অন্য ট্রাকে চড়ে। দীন আলি মাষ্টার ছেলের গায়ে হাত দিতেই ছেলে ভয়ে লাফিয়ে উঠল। হঠাৎ করে দীন আলি মাষ্টারের মেজাজ আগুন থেকে পানি হয়ে গেল। ছেলের গায়ে মুখে আদরের পরশ বুলিয়ে আস্তে আস্তে বুকের মধ্যে নিয়ে বলল, ‘বাবারে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তোমাকে পড়ার ঘরে না ঠেললে পড়তে বস না। এখাবে কি পড়াশুনা করানো সম্ভব? নিজের ইচ্ছার সাথে সাধনা, স্বপ্ন নিয়ে পড়ার টেবিলে যেতে হয়। দাদুর ট্রাকের দিকে তাকিয়ে দেখ। না ঠেললে ষ্ট্রার্ট হল না। শত চেষ্টা করেও স্বয়ংক্রিয় ষ্ট্রার্ট হল না। আজ সেই ট্রাক, ট্রাক থেকে যন্ত্রাংশে পরিনত হয়ে ঢাকায় চলে যাচ্ছে। তুমিও এভাবে পথ চললে একদিন হৈবতের ট্রাক হয়ে যাবে।’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

ট্যাগ সমূহ

ঝিকরগাছার ইতিহাস, ঝিকরগাছা উপজেলার ইউনিয়ন, ঝিকরগাছা খবর, গদখালি ঝিকরগাছা, ঝিকরগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান, ঝিকরগাছা পোস্ট কোড, ঝিকরগাছা এমপি, ঝিকরগাছা আবহাওয়া, ঝিকরগাছা উপজেলা ম্যাপ, ঝিকগাছার ঐতিহ্য, পানিসারা, ঝিকরগাছা পৌরসভা, ঝিকরগাছা দর্শনীয় স্থান, ঝিকরগাছা বাজার।