চিঠিটির প্রাপক হোসেনউদ্দীন হোসেন। আজকের বাংলা একাডেমী পুরষ্কারপ্রাপ্ত হোসেনউদ্দীন হোসেনের বয়স সে সময়ে কত? মাত্র ২০ বছর। সেদিনের সেই তরুণের কাছে লেখা চিঠিটি নিয়ে আজ এই নববর্ষের ক্ষণে কেন আলাপ করছি? কারণ কুমিল্লা সেট্রাল জেল থেকে লেখা রাজনৈতিক বন্দী মারুফ হোসেনের লেখা এই চিঠিটির মূল বিষয়বস্তুও নববর্ষ। ২৯ ডিসেম্বর ১৯৬১ সালে লেখা এই চিঠিতে দেখা যায় তরুণ হোসেনউদ্দীন হোসেনকে তিনি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে উপহারস্বরুপ একটি কবিতা ও একটি হাতে আঁকা ছবি পাঠিয়েছেন।
আজ ০১ বৈশাখ ১৪৩০ বাংলা নববর্ষের ক্ষণে সেই চিঠি, কবিতা এবং ছবিটি প্রকাশিত হলো। এই চিঠিটি থেকে তৎকালীন ঝিকরগাছার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ কেমন ছিল তা কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়।
মারুফ হোসেনের লেখা চিঠি |
সেন্ট্রাল জেল, কুমিল্লা
২৯শে ডিসেম্বর ৬১
প্রিয় হোসেন ভাই,
আসছে নব-বর্ষে তুমি আমার স্নেহ-প্রীতি ও শুভেচ্ছা লও। নব-বর্ষ উপলক্ষে তোমাকে দেবার মত সামর্থ আমার নেই। তুমি কবি, তাই তোমার মর্যাদা অনুপাতে তোমাকে একখানি আমারই হাতে আঁকা, বর্ষ শেষের গোধুলী সন্ধ্যার প্রতিচ্ছবি পাঠালাম। ক্লান্তি শেষে দিনান্তের শেষ আলো স্তীমিত হবার আগে, গ্রাম বাঙলার প্রাণ; কৃষকদের ঘরে ফেরার আনন্দ মুখর এই চিত্রখানি, তোমার কবিচিত্তকে উদ্বেলিত করাতে পারলে, স্বার্থক বোধ করব।
এই সঙ্গে, চিত্রের পাশে তোমাকে আরও একটি আমার কবিতা পাঠালাম। গুনাগুণ বিচার সাপেক্ষ। উচ্চমাপের কি নিম্নমাপের সে বিচার তোমার। নববর্ষের প্রাত স্বাগতম জানাতে, যেটুকু আবেগ সংগ্রহ করতে পেরেছি তাই তোমাকে নিঃসংকোচে উজাড় করে দিলাম। গ্রহণ করলে সুখী হব। সমালোচনায় বেত্রাঘাত করলে আরও সুখী হব।
নববর্ষ সবার জীবনে সার্থকতা নিয়ে আসুক। কামনা-বিদুর মানুষের মন, কামনা-সাফল্যের আনন্দে পরিপূর্ণ হোক। এইটুকু অন্তর নিংড়ানো প্রার্থনা রইল। আর অফুরন্ত ভালবাসা রইল।
ইতি,
তোমার প্রীতিমুগ্ধ
মারুফ ভাই
মারুফ হোসেন-এর প্রেরিত কবিতা |
জয়তু নববর্ষ
হে মোর দগ্ধ অন্তর, অশান্ত হৃদয়!শান্ত হও, স্তব্ধ কর তব অশ্রুনীর।
নিমিলিত অশ্রুকুয়াসা ঘেরা তব চক্ষুযুগল –
পূনর্বার করো উন্মিলন, দেখ চাহি;
গোধুলী – সন্ধ্যার রক্তরাগে, মাগিছে বিদায় –
বিশীর্ণ, কলঙ্কিত তব অশান্ত, বিগত বৎসর।
মহাকালের অঙ্কে হতে লীন!
অতঃপর, হে মোর বিদগ্ধ অন্তর!
সকল বিহবলতার মাঝে যেটুকু, পেয়েছো
সবলতা; সর্য-শিব-সুন্দর; তারে বক্ষে লয়ে
বাহু বেষ্টনে আঁকড়িয়ে ধরি, অসত্যরে;
- অসুন্দর তুমি
ঘৃণাভরে দাও ক্ষমা করি।
তারপর; অতীতের পলিতে অবশিষ্ট
যেটুকু আছে, অন্তঃসার;
জীবনের বেলাভুমে যেটুকু-জেগেছে,
প্রতিশ্রুতি – নতুন একটি উষা, নতুন একটি দিন
নতুন যে আরে একটি বছর –
সেই প্রতিশ্রুতিঃ-
অতীতের যজ্ঞ-ভষ্ম দিয়ে, করুক অঙ্কিত আজ –
তোমারই ললাটে – বিজয় তিলক।
জয়তু হে নববর্ষ –
নতুন দিগন্ত তব উদ্ভসিত হোক।।
-
মারুফ হোসেন
কুমিল্লা জেল।
২৯.১২.৬১
কুমিল্লা জেল।
২৯.১২.৬১
মারুফ হোসেনের নিজের আঁকা স্কেচ |