ঝিকরগাছায় ২৫ ও ২৬ মার্চ, ১৯৭১ |
সময় বয়ে যায়, মানুষ চলে যায়, ইতিহাস কথা কয়। সব কথা মুছে যায় না, কিছু কথা রয়ে যায়, কালের কষ্টি পাথরে তা টিকে থাকে। হাজার বছরের দীর্ঘ সংগ্রামের পথ বেয়ে পরাধীনতা ও ঔপনিবেশিকতার জিঞ্জির ছিন্ন করে পরিশেষে চিরদিনের জন্য মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এক পরম বিস্ময়। তিতুমীর, এ,কে, ফজলুল হক, সূর্যসেন, সোহরাওয়ার্দী, মৌলনা ভাসানী থেকে বহু সংগ্রামী বীর বাঙালির ইম্পিত মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করলেন শতাব্দির শ্রেষ্ঠ ক্ষণজন্মা অকুতোভয় বাংলার অবিস্মরণীয় বীর সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম একদিনের নয়, দীর্ঘ দিনের। এ সংগ্রামে কত জীবন অকালে ঝরে গেল, কত ত্যাগ তিতিক্ষা কষ্ট, ধৈর্য, ক্ষতি তার হিসেব পর্যালোচনা করলে চরম বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যেতে হয়। দীর্ঘ সংগ্রামের হিসেবের খতীয়ানই হলো বাংলার ইতিহাস। এ ইতিহাস বাংলার মুক্তি সনদ, এ ইতিহাস অগণিত অপরাজেয় বীর বাঙালির গৌরব গাঁথা, এ ইতিহাস আগামী দিনের বীর বাঙালিদের জাগ্রত বিবেকের রক্ষা কবচ। এ ইতিহাস যারা জানে না, জানবার চেষ্টাও করে না, জেনেও না জানার ভান করে, বাংলার মাটির গন্ধ শুকে দেখে না, এমন ধরণের এক কিসিমের মানুষ বাংলার বুকে বার বার জন্ম নেবে আগাছার মত এবং বিভিন্ন ঢংয়ে বিভিন্ন বেশে নর্তন কুর্দন করে শ্বাসত বাংলার গতি ধারায় অনাসৃষ্টি ঘটাবার প্রয়াস পাবে; কিন্তু দেশ ও সমাজের জাগ্রত চেতনা তাকে রুখে দিয়ে প্রতিহত করবে। পৃথিবীর বুকে দ্বন্দ্ব ছিল, আছে, থাকবে। দ্বন্দ্ব প্রতিটি প্রাণীর দেহে ও মনে । দ্বন্দ্ব বিহীন প্রাণ হতে পারে না। এটা একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। বিদ্যুতের নেগেটিভ পজিটিভের মত- যা নিয়ন্ত্রিত পন্থায় নিত্যদিন আমাদের সামনেই বিজলী বাতি জ্বালায় এবং নানা বিদ্যুত চালিত ক্রিয়া কান্ড সম্পাদন করে । কিন্তু কোন সময় শর্ট সার্কিট হয়ে গেলে তা অনিবার্য ভাবেই ধ্বংস বয়ে আনে। ঠিক তেমনি দেশ ও সমাজের মাঝে গতি সঞ্চারণের নিয়ামক শক্তি হলো দ্বন্দ্ব, এই দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় প্রকৃতির রূপ ধরে বয়ে আনে কল্যাণ। কিন্তু কোন সময় দ্বন্দ্ব যদি বিদ্যুতের মত নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে পড়ে তাহলে তা দেশ ও সমাজের বুকে নিশ্চিত ভাবেই ধ্বংস বয়ে আনে অথবা চলার পথ মস্থর করে দেয়।
তাই দ্বন্দ্বহীন দেশ ও সমাজ যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি আবার দ্বন্দ্বসমূহকে নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও করা যায় না। এ জন্য সমগ্র জাতি ও সমাজকে জাগ্রত ও সতর্ক থাকতে হয়, বারবার বাংলার সংগ্রামী ইতিহাস পাঠ থেকে শান দিয়ে নিতে হয় চেতনবোধকে । দেশের জন্য, মানুষের জন্য, ভাষার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, দেশের স্বাধীনতা ও কল্যাণের জন্য যে সব বীর বাঙালি প্রাণ দিয়ে গেল, আজীবন সংগ্রাম করে গেল তাদের বীর গাঁথা আলেখ্য পড়তে হবে জানতে হবে, তাহলেই দেশের অকল্যাণকামী শক্তিকে প্রতিহত করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে সার্বিক মঙ্গল সাধন করা সহজ ও সম্ভব হবে।
২৫ মার্চের রাত ১২টার পরেই ২৬ মার্চ বাংলার স্বাধীনতার গৌরবোজ্জ্বল দিন, তাকে সামনে রেখে আজ অনেক কথাই মনে পড়ছে। ১৯৭১ এর মার্চ অসহযোগের মাস, স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরুর মাস, বাংলার মানুষের মনে চির লুকায়িত স্বপ্নের দেশ স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার ও প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানি উপনিবেশবাদের জেল, জুলুম, শোষণ, অত্যাচার ও গণহত্যার প্রতিবাদে। অসহযোগের ডাক। ৭ মার্চে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রের মাঝে বাংলার আপামর জনগণের উদ্দেশ্যে দেওয়া পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগের ডাক, পাকিস্তানি উপনিবেশবাদের জিঞ্জির থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বাতাস কাঁপানো হৃদয় নিংড়ানো বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ডাক 'আজ থেকে খাজনা ট্যাক্স সব বন্ধ করে দেবে, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়বে, রক্ত যখন দিয়েছি- রক্ত আরও দেব, এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মার্চ মাসে বাংলাদেশ গণসংগ্রামের বিপ্লবী জোয়ারে উত্থাল পাতাল অবস্থা। সেদিন আমরা ঝিকরগাছায় আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ, যুব সংগঠন, ছাত্রলীগ, কৃষকলীগ, শ্রমিকলীগ প্রভৃতি সংগঠনের কর্মতৎপরতা অভূতপূর্ব ভাবে যৌথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিপ্লবী ভূমিকা পালন করে চলেছি। সবার নাম এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। সবার অবদান কম নয় । তবু চেনা জানা কয়েক জনের নাম এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য । মরহুম আলতাফ হোসেন, মরহুম রওশন আলী (তারা ঝিকরগাছা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন), মরহুম আলহাজ নূরবকস (প্রাক্তন সভাপতি ঝিকরগাছা ও যশোর জেলা আওয়ামীলীগ), মরহুম আলহাজ মাজেদ বকস (কীর্তিপুর, প্রাক্তন ঝিকরগাছা আওয়ামীলীগ সভাপতি), মরহুম আবদুস সোবহান (বাজার), আব্দুল আজিজ (মোবারকপুর), আবদুল আজিজ (বারবাকপুর), অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম (সাবেক এমপি), আলহাজ ডা. আবুল ইসলাম (প্রাক্তন এমপি), রশীদুর রহমান রশীদ (ছাত্রলীগ), আবদুল লতিফ (ছাত্রলীগ), রেজাউল হক (কীর্তিপুর), আবু তালেব (বাজার), আকবর হোসেন (ভাসানী), ইউসুফ আলী (বাজার), অজিত তুমার পাল (কীর্তিপুর), মাস্টার ভবিবর রহমান, নুরুল ইসলাম (নুরুল ভাই কৃষ্ণনগর) প্রভৃতি নাম উল্লেখ করা মানে স্বাধীনতা সংগ্রামটাকে ছোট করে দেখানো । কারণ সমগ্র ঝিকরগাছা, থানার স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ লোক যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন দু'চারজনের নাম উল্লেখ করে সীমাহীন উত্তাল বিপ্লবী জনতাকে খাটো করে দেখানো হয়ে যায়
যাই হোক ২৫ মার্চের সেই কালো রাতের কয়েক দিন আগে ২২ মার্চ অ্যাডভোকেট আবদুল আজিজ আমাকে সঙ্গে নিয়ে শহীদ মশিয়ূর রহমানের সাথে দেখা করতে গেলেন। শহীদ মশিয়ূর রহমানের সাথে দেখা হলো না। তিনি তখন ঢাকায় বাংলাদেশের সামগ্রিক যুদ্ধ পরিকল্পনার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনারত। ঢাকা থেকে তিনি ফিরে আসলে অ্যাডভোকেট আবদুল আজিজ মারফৎ ইঙ্গিতে আমাকে সংবাদ দিলেন এই বলে যে, 'আগামী কাল ২৬ মার্চের সকাল শুভ ও হতে পারে, অশুভ হতে পারে। সকালের রেডিও শুনে তারপর তার সাথে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত যেন আমরা নিই।' তার দেওয়া সংবাদটি দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আমাদেরকে আরও ভাবিয়ে তুলল । চারিদিকে আমরা জনগণের মধ্যে যুদ্ধংদেহী মনোভাব গড়ে তোলার কেন্দ্রীয় নীতি নির্দেশ মোতাবেক পরিকল্পনা প্রস্তুতি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছি। রাত্র সাড়ে আটটা নয়টার সময় আমরা অনেকেই মরহুম আলতাফ হোসেনের কাপড়ের দোকানে বসে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছি ও রেডিও শুনছি। রেডিওতে পাক সরকার ঘন ঘন বলছে সকল আগ্নেয়অস্ত্র নিকটস্থ থানায় জমা দিতে। আর আমাদের কেন্দ্রীয় নির্দেশ হচ্ছে দেশে যুদ্ধ বেঁধে যাচ্ছে, যার যার নিরাপত্তার জন্য কেউ যেন বন্দুক বা কোন আগ্নেয়অস্ত্র রেখে দেবে। ফোনের রিং বেজে উঠলো মকবুল হোসেন (মোবারকপুর) মজিদ কোম্পানির মিল থেকে আমাদেরকে ফোন করে জানালেন 'একটু আগে শহীদ মশিয়ূর রহমানের সাথে কথা হলো, তিনি বললেন, বাসা থেকে গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি এবং যশোর রেল স্টেশনের দিকে আগুনের হলকা দেখতে পাচ্ছি, এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।' মকবুল হোসেন বললেন, তারপর যশোরে শহীদ মশিয়ূর রহমানের সাথে ফোনে আর যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। মনে হয়। ফোনের লাইন কেটে দিয়েছে। আসলে সেই সময় পাক বাহিনী যশোর টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অফিস চারিদিক থেকে ঘেরাও করে অনবরত ফায়ারিং করে অফিসটাকে তছনছ করে দিয়েছে।
তখন আমরা সবাই যুদ্ধ উন্মাদনায় উন্মত্ত। এত রাতেও বাজারে লোকের আনাগোনার কমতি নেই, কেউ যেন বাড়িতে চুপ করে বসে থাকতে পারছে না, কখন কি অবস্থা হয় যুদ্ধের আতঙ্কে অনেক পরিবার উদ্বেগাকুল রাত ১১ টা বাজে। একজন আমাকে ডেকে বলল, যশোর থেকে কয়েক জন আর্মি এসেছে, ব্রিজের সামনে গাড়ি রেখেছে, ওখানে আপনাকে ডাকছে, কি যেন বলতে চায় । আমি বললাম, আর কাউকে না? তিনি বললেন, না শুধু আপনাকে।
আমি আল্লাহর নাম নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে একাই চিন্তিত মনে অথচ মনে সাহস সঞ্চ করে এগিয়ে গেলাম মিলিটারি গাড়ির কাছে। আমাকে দেখে গাড়ি থেকে দুই তিন জন লোক বেরিয়ে এলো। একজন বললেন, আপনি কি থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি ডা. গোলাম সরওয়ার? আমি বললাম হ্যাঁ। তখন তারা আমার সাথে শক্ত হাতে হ্যান্ডশেক করলেন এবং বললেন, এখানে ঝিকরগাছায় কি কি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে। আমি বললাম বেশি কিছু নয় ছোট টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অফিস ও নদীর উপর দু'টি ব্রিজ।
তারা বললেন, শেখ সাহেব আওয়ামী লীগের যে রূপ নির্দেশ দিয়েছেন আপনারা সেই মত কাজ করে যাবেন, আর আমরা যারা বাঙালি মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টে আছি তারাতো জীবন পণ যুদ্ধ করবোই। এই বলে তার মধ্যে একজন তার হাতের লোমকুপগুলি খাড়া হয়ে উঠেছে তা দেখায়ে বললেন, আসি, সময় কম। এই বলে গাড়ি ব্রিজের উপর দিয়ে চালিয়ে উপরের দিকে গেলো এবং বেশ কিছুক্ষণ পর গাড়িটিকে যশোরের দিকে ফিরে যেতে দেখলাম, সম্ভবত: থানা ঘুরে গেল । আলতাফ হোসের ঘরে বসে স্থির হয়ে গেলো যশোর রোডের ধারের শিশু গাছ কেটে রাস্তায় বেরিকেড সৃষ্টি করতে হবে। যার যার মত করণীয় কাজ করে যাবে এই বলে আমি রাত ১২ টার পর বাসায় ফিরলাম। আমি ভোর রাতে স্বপ্ন দেখছি সমগ্র ঝিকরগাছায় মিলিটারি এসে ঘিরে ফেলেছে। আমি ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। খুব দ্রুত ফজরের নামাজ ও অন্যান্য কাজ সেরে আমি বাজারের দিকে পা বাড়ালাম। পূর্ব আকাশে বেলা তখন উঠছে দেখলাম যশোর রোড লোকে লোকারণ্য। আকবর হোসেন (ভাসানী) বললেন, সারারাত ধরে মানুষ সব রাস্তার ধারের বেশ কিছু গাছ কেটে রাস্তায় দারুণ বেরিকেড সৃষ্টি করেছে। মিলিটারিরা গাড়ি নিয়ে সহসা আসতে পারছে না।
আমি সোজা চলে গেলাম তদানীন্তন সি, ও (ডেভ) এর কাছে। সেখানে যেয়ে দেখলাম আমাদের সংগ্রামী নেতা আলহাজ ডা. আবুল ইসলাম (প্রাক্তন এম পি) এর সাথে বসে কথা বলছেন। আমাকে দেখে বললেন, কিছু বলবেন? আমি বললাম দেশের এই দুর্দিনে আমি জনগণের তরফ হতে স্থানীয় প্রশাসন সি,ও সাহেবের সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস নিতে এসেছি। তিনি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'ডাক্তার সাহেব আমি আপনাকে জানি, আপনি বড়ই ভাল মানুষ, আপনি নিজের কথা ভাবুন। আমি বললাম আমি নিজের কথা বলতে আসেনি, আপনি একজন প্রশাসক, সাধ্যমত আপনি আপনার জনগণকে বাঁচার প্রশ্নে সাহায্য করবেন এই আশ্বাস নিয়ে আমি যেতে চাই। হেসে বললেন, আচ্ছা হবে। ওখান থেকে আমি চলে এলাম আবদুস সামাদের (বড় সাহেব) বসার ঘরে। সেখানে যেয়ে দেখি বাজারের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি তার সাথে কথা বলছেন। আমার যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করে বসতে বললেন। আমি বললাম, আপনারা অনেকেই এখানে উপস্থিত আছেন ভালই হলো। আমি বলতে এসেছি দয়া করে আপনারা কেউ থানায় বন্দুক জমা দেবেন না। আপনাদের বন্দুক আপনাদের স্ব-স্ব নিরাপত্তার জন্য কাছেই রাখুন । সামাদ সাহেব বললেন, সরকার বলছে জমা দিতে, আপনি বলছেন জমা না দিতে। থানার ওসি কি তা শুনবে? আমি বললাম, শুনবে। তিনি বললেন, যদি তাই হয় তাহলে ওসি সাহেবকে বলুন জমা না নিতে । আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি তার কাছেই যাচ্ছি।
তখন ঝিকরগাছার ওসি জাকারিয়া সাহেব অতি ভদ্রলোক তিনি আমাকে দেখে সালাম বিনিময়ের পর বললেন, কি খবর ডাক্তার সাহেব? তখন অফিসে বাইরের কেউ নেই । আমি বললাম, দেশের এই দুর্দিনে আপনার সার্বিক সহযোগিতা কামনা করি। প্রতি উত্তরে তিনি বললেন, “আমার সাধ্যমত আমি করবো, তবে আমার নিজের কি অবস্থা হবে আমি সেটাই বুজতে পারছি না। আপনার লোকেরা থানায় কেন বন্দুক জমা দিতে আসছে; যার যার বন্দুক তার তার কাছে রাখুক তার নিজের নিরাপত্তার জন্য। তারা আমার এখানে আনলে তো জমা না নিয়ে পারিনে। আপনার লোক মোড়ের মাথায় বসিয়ে রাখুন কেউ যেন বন্দুক নিয়ে থানায় জমা দিতে না আসে। মিলিটারিরা যখন আসবে তখন আমার এখানেই তারা আগে আসবে এবং আমাকে সঙ্গে নিয়েই আপনাদেরকে ধরতে বাধ্য করবে। তবে আপনাকে এইটুকু আশ্বাস দিতে পারি যে আপনাদেরকে ধরতে যাওয়ার আগে আমি চেষ্টা করবো আপনাদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে।
আমি চলে এলাম এক বুক ভরসা নিয়ে আমার সেদিন বাঁকড়ার চেম্বারে রোগী দেখার দ্বি-সাপ্তাহিক প্রোগ্রাম । তাই ওখান থেকে এসেই আমাদের কতিপয় আওয়ামীলীগ কর্মীর সাথে কথা বলে আমি মোটরসাইকেল নিয়ে বাঁকড়ার পথে রওনা হলাম। পার-বাজারের সীমানার কয়েক গজ দূরে দূরে কয়েকটি বড় বড় শিশু গাছ কেটে রাস্তায় বেরিকেড সৃষ্টি করেছে স্থানীয় কর্মীরা আমি অতি কষ্টে মোটরসাইকেলটা পার করে নিয়ে গেলাম। এর প্রায় পর পরই যশোর থেকে মিলিটারির গাড়ি মিলিটারী কায়দায় অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে রাস্তার সকল বেরিকেড সরিয়ে দিতে দিতে ঝিকরগাছায় সকাল ১০/১১ টার মধ্যে পৌঁছে গেল । ওসিকে সঙ্গে নিয়ে তারা আলতাফ হোসেনকে ধরতে গেল। ওসির দেওয়া সময় পেয়ে তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন অ্যাডভোকেট আবদুল আজিজ পালাবার সময় পেয়েও পালাবার বুদ্ধি করে উঠতে পারেননি । তাই ধরা পড়ে জেলে গেলেন। আমার বাড়ি ঘেরাও করে ফার্মেসি থেকে আমার মামা ও মামাতো ভাই আনওয়ারুলকে ধরে থানায় নিয়ে গেলেন । ওদের ছেড়ে দিলেন এই বলে যে ওইদিন সন্ধ্যার মধ্যে আমাকে থানায় হাজির করে দিতে হবে। এই বলে আবার মামাকে পাশে ডেকে নিয়ে খুব আস্তে। আস্তে বললেন, ডাক্তার সাহেবকে হাজির করতে হবে না, তবে তাকে সংবাদ দিন এখুনি যেন তিনি বাঁকড়ার বাড়িতেও না থাকেন। এই ভাবে সেদিন প্রশাসনের ব্যক্তিরাও স্বাধীনতা সংগ্রামে পরোক্ষ ও প্রত্যেক্ষ ভাবে সাহায্য করেছিলেন। বেশ পরে ওসি জাকারিয়ার সাথে আমার দেখা হলে বিস্তারিত তিনি খুলে বলেন। তিনিও অবশ্য পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেমে পড়েন।
সেই সব মানুষদের জন্য আমরা কি দিতে পেরেছি তা জানি না। যারা শহীদ হয়েছেন বা স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেছেন তাদেরকে তো আমরা ভুলতে বসেছি আর যারা বেঁচে আছেন তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে কসুর করছি। পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেরা জানতেই পারলো না সেদিনের সেই সব বীর বাঙালি কারা ছিল এবং কারা সংগ্রাম করে এদেশটাকে মুক্ত স্বাধীন করলো। মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কোথায় কার কবর, তার খবর রাখা বা কবর জেয়ারত করা বা তাদের নামে বিভিন্ন সময়ে সাময়িক পত্র পত্রিকা বের করা এর কোনটাই যথাযথ ভাবে করা হয় না। উপজেলা চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় রশীদুর রহমান রশীদ কিছুটা করতে পেরেছেন, তাহলো উজ্জ্বলপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের কবরখানা পর্যন্ত বাঁকড়া বাজার থেকে একটা সড়ক নির্মাণের গৃহীত প্রকল্প। এ জন্য ধন্যবাদ সকলকে।