[পর্ব ২] কালান্তরের রূপকথা • ধারাবাহিক উপন্যাস

[পর্ব ২] কালান্তরের রূপকথা • ধারাবাহিক উপন্যাস


প্রথম পর্বের পর

দুই

রাতটা দারুণ একটা শঙ্কার মধ্যে দিয়ে কেটেছে পূর্ণ দফাদারের। দুপুর রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছে সে। সেই স্বপ্ন দেখে সে ঘুমুতে পারেনি। ভয়ে তার সর্বাঙ্গ আড়ষ্ট হয়ে আছে। আতঙ্কে মনটা ভরে রয়েছে। গিন্নিকে ঘুম থেকে তুলে এক গ্লাস জল আনতে বললো।

- ওগো, গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠেে
- ক্যানো, কী হয়েছে তোমার?
- একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছি শান্তা।
- কী স্বপ্ন দেখেছো আবার?
- আগে জল আনো। তারপর বিষয়টি বলবানে।

শান্তারানি খাট থেকে নেমে এক গ্লাস জল আনলো। গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক চুমুকে জল পান করলো পূর্ণ দফাদার।

- একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি শান্তা।
-আরে বলো না তোমার স্বপ্নটা কী? গলা আটকে আসছে শান্তা।
- আচ্ছা, ঠিক আছে, তা হলে সকাল বেলা শুনব। এখন একটু চুপচাপ ঘুমোও।

বালিশে আবার মাথা রাখলো পূর্ণ দফাদার। বুকটা হাঁসফাঁস করছে। শান্তারানি পাশের বালিশে মাথা রেখে ওর বুকের উপর হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। কিছুতেই ঘুম আসছে না পূর্ণ দফাদারের। চোখের পর্দায় ভেসে উঠছে স্বপ্নে দেখা দৃশ্য। একজন অপরূপ সুন্দরী নারী। গ্রামের চৌমাথায় দাঁড়িয়ে আছে। খোলামাথা চুল হাঁটু পর্যন্ত গড়িয়ে পড়েছে। তার হাতে অসংখ্য মুণ্ডু। সে বিড়বিড় করে বলছে, খাবো। মুণ্ডু খাবো। কলজে খাবো। গ্রামটাও গিলে খাবো। চাঁদ খাবো। সূর্য খাবো। আকাশ খাবো। নক্ষত্র খাবো। সকাল খাবো। দুপুর খাবো। সন্ধ্যে খাবো। দে-মুণ্ডু দে-।

পূর্ণ দফাদার হাত জোড় করে বললো, না মা, তুমি আমাদের কোনো অনিষ্ট করো না। আমরা কোনো অপরাধ করিনি। তুমি আমাদের মার্জনা কর।
- আমি যখন এসেছি তখন শূন্য হাতে ফিরে যাব না।
একটা কিছু ওলট পালট করে দিয়ে যাব। যা আমার সামনে থেকে সরে যা- লাল টক টকে জবা কুসুমের মতো শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে রমণী। ভয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগলো পূর্ণ দফাদার। একটা ঝড়ের মতো বাতাস ঘুরপাক খেয়ে আকাশের দিকে ঠেলে উঠলো। পূর্ণ দফাদার মাটিতে পড়ে হাত পা ছুড়তে লাগলো। দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগলো পূর্ণ দফাদারের। দৃশ্যটা চোখের সামনে ঝুলে রয়েছে এখনো।

ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই বিছানা থেকে উঠে পড়লো পূর্ণ দফাদার। প্রাতঃকর্ম সেরে গামছাটা ঘাড়ে করে নদের দিকে হেঁটে গেল সে। বাড়ি থেকে দুশো গজ দূরে নদ। ঘাটে নেমে স্বচ্ছ জলের ভেতরে কয়েকটা ডুব দিয়ে শরীরটা পূত করে তুললো। পূর্ব মুখো দাঁড়িয়ে কয়েকবার নমঃ নমঃ মন্ত্রোচ্চারণ করলো। সকল বালাই মুসিবত থেকে রক্ষা করো ভগবান। তুমি মঙ্গল করো। হে দয়াময় । গৃহে গিয়ে কাপড় পরে গৃহ দেবতাকে প্রণাম করলো পূর্ণ দফাদার। ভোরের বাতাস ধূপের গন্ধে ভরে উঠলো। পূজা পার্বণ সেরে পরনের শাদা ধুতিটা গায়ে জড়িয়ে মন্দিরের উদ্দেশে রওনা হলো। মন্দিরের সেবাইত রামকান্ত উপপাধ্যায়। ঠাকুরঘরে বসে পূজা অর্চনা শেষ করে গীতা পাঠ করছিলেন। পূর্ণ দফাদার তার কাছে গিয়ে নমস্কার করলো।

রামকান্ত উপপাধ্যায় শুধু পুরুত ব্রাহ্মণ নন - একজন গণক ঠাকুরও বটে। স্বপ্নতত্ত্বেরও একজন ব্যাখ্যাকারক। তিনি পূর্ণ দফাদারের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।

- কী মনে করে এখানে এসেছ দফাদার?
- ঠাকুর, একটা বিষয় সম্পর্কে জানতে এসেছি।

রামকান্ত উপপাধ্যায় পূর্ণ দফাদারকে উপবেশন করতে বললেন।

- ঠিক আছে, বসো, কথা বলা যাক। বিষয়টি কি খুব জরুরি?
- আজ্ঞে ঠাকুর, জরুরি বলেই এসেছি।

ঠাকুরের মুখোমুখি বসলো পূর্ণ দফাদার।

- আজ রাতে একটা ভয়াবহ স্বপ্ন দেখেছি ঠাকুর। মনটা দারুণ খারাপ। বুঝতে পারছি না কপালে কি আছে। তাই ভোর বেলা ছুটে এসেছি।

- বলো, স্বপ্নের বিত্তান্ত শুনি । পূর্ণ দফাদার স্বপ্নের বিত্তান্ত খুলে বললো। ঠাকুর ঝিম মেরে বিষয়টি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। উঠে গিয়ে মন্দিরের মূর্তির পাশে রাখা একটা বই টেনে আনলেন।

আমার পূর্ব পুরুষেরা আজ কোথায়? তাদের ছায়াও নেই। তাদের প্রতিনিধি হয়ে আমরাই বেঁচে আছি। একদিন আমরাও থাকব না। আমি যাব শ্মশানে, তুমি যাবে কবরে। কোনো পার্থক্য নেই। কঙ্কাল মাটিতে পচে যাবে। কেউ থাকবে না।

বইটি স্বপ্নতত্ত্ব বিষয়ক। অনেকক্ষণ ধরে বইটি খুলে ঘাটাঘাটি করলেন। চোখের দৃষ্টি তার বইয়ের ভেতরে। বিড়বিড় করে কী যেন পাঠ করতে লাগলেন। ১১ই চৈত্র, ৬/১১৫২, ৬-১৫ অন্ত বুধবার, দ্বাদশী 8 / 8, ধনিষ্ঠ নক্ষত্র রাত ৭/৩০, যাত্রা নাস্তি। দফাদার, গতকাল রাতটা ছিল ভয়ঙ্কর বটে। তুমি যাকে স্বপ্নে দেখেছ, ইনিতো বালাই দেবী, এই অঞ্চলে তিনি আগমন করেছেন। আমি এখন কী করতে পারি ঠাকুর?

- উনি যখন পদার্পণ করেছেন, তখন কিছু না কিছু ক্ষতি তো করবেন। তার হাত থেকে নিস্তার নেই।
- কী পূজা করলে খুশি হবেন, ঠাকুর?

একটু ভেবে দেখতে হবে, দফাদার। মা রাক্ষসী হয়ে এসেছেন। একটু ভেবে দেখতে হবে। পাপে ছয়লাব হয়ে যাচ্ছে দেশ। আমাকে কী করতে হবে, তাই বলুন? আমার সঙ্গে কেন তিনি স্বপ্নে দেখা দিলেন? আমি তো ভাবতেই পারিনি, তিনি কেন দেখা দিলেন? - হ্যাঁ, এটাও একটা বিষয়। এই রহস্যের বিষয়টি আমিও তো জানি নে দফাদার।

- বলুন, এখন আমার কী কর্তব্য।

রামকান্ত উপপাধ্যায় আবার বইয়ের দিকে দৃষ্টি দিলেন।

- ঠাকুর, এখন কী করতে হবে বলুন?
- সেটাই তো ভাবছি দফাদার, এখন করণীয় কী?
- বালাই দেবী কেন আমাকে দর্শন দিলেন?

একটা কাজ করা যেতে পারে দফাদার, দেবী যখন গ্রামেই ঢুকেছেন, তখন ছাপ্পানো প্রহরব্যাপী নামযজ্ঞ করলে হয়ত এই বিপদ থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে।

-তবে সেই আয়োজন করুন ঠাকুর মশায়।
- আজই সন্ধ্যেবেলা নাটমন্দিরে সমাজের সবাইকে নিয়ে বসি। দেখি, কী করা যায়।

পূর্ণ দফাদার উঠে দাঁড়ালো। তা হলে ঠাকুর মশায়, আমি সন্ধ্যে বেলা করণীয় বিষয় নিয়ে আলাপ করব।

মাথার মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা চেপে বসলো পূর্ণ দফাদারের। এত লোক রয়েছে এই গ্রামে, কাউকে দেবীদর্শন দেননি। দর্শন দিয়েছেন শুধু পূর্ণ দফাদারকে। নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করলো সে, দেবী কেন আমাকে দর্শন দিলেন? এরমধ্যে নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। উদ্দেশ্যটা তো মঙ্গলও হতে পারে কিংবা অমঙ্গলও হতে পারে। কয়েকবার রাম রাম বলে কপালে হাত ঠেকালো পূর্ণ দফাদার। মা, তুমি মঙ্গল করো, মা, তুমি এই অধমকে কৃপা করো। আমি পাপী- তাপী মানুষ, আমাকে কেন তুমি দর্শন দিলে মা? মনের মধ্যে একটা ভাবাবেগ উতলে উঠলো ।

দুপুর বেলা পর্যন্ত এপাড়া-ওপাড়া ঘোরাঘুরি করে কাটালো পূর্ণ দফাদার। মনটা অশান্তিতে ভরে আছে। নদীর পাড় ঘেঁষে হিন্দুপাড়া। পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত বিস্ত ত। অর্থাৎ গ্রামের দক্ষিণ দিকে হিন্দুদের বাস। উত্তর দিকে মুসলমান পাড়া। অর্থ বিত্তে হিন্দু সম্প্রদায়ের অবস্থা সচ্ছল। প্রভাব ও প্রতিপত্তি নিয়ে বহুকাল ধরে তারা এই গ্রামে বসবাস করছে। বাগ বংশ, সরকার বংশ, দফাদার বংশ ছাড়াও রয়েছে মুখোপাধ্যায়, চক্রবর্তী ও উপপাধ্যায় বংশ। সব পাড়া ঘুরতে ঘুরতে মাথার উপর সূর্য উঠে এলো। চৈত্র মাসের রৌদ্রে টগবগ করে ফুটছে। মাঝে মাঝে ঘূর্ণি হাওয়া ধুলো আর খড়কুটো উড়িয়ে উত্তর দিকে ভেগে যাচ্ছে। এপাড়া ওপাড়া গিয়েও স্বস্তি নেই। ওলাওঠার দাপটে সারা গ্রামটা তটস্থ। বাড়িগুলো শোকে কাতর। সান্ত না দেয়ারও লোক নেই। কারো ছেলে মরেছে। কারা মেয়ে মরেছে। কারো স্বামী মরেছে। কারো বউ মরেছে। কেউ বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছে। খা খা করছে পরিত্যক্ত বাড়ি। জেলে পাড়ায় ঢুকতেই কয়েকটা গৃহপালিত কুকুর সমস্বরে হাউমাউ করে ডেকে উঠলো। বুকটা ফেটে যেতে লাগলো পূর্ণ দফাদারের। কুকুরগুলোর কান্না বাতাসে করুণ হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে গেল। গা ভারি হয়ে উঠলো মুহূর্তেই। হাঁটতে হাঁটতে মুসলমান পাড়ায় ঢুকলো পূর্ণ দফাদার। বাঁশ বাগানের ভেতর দিয়ে সর্দার পাড়ায় ঢুকলো সে। একটা আম বাগান পার হয়ে আজু মোড়লের উঠোনের উপর এসে দাঁড়ালো পূর্ণ দফাদার। কোথায়ও কোনো হইচই নেই। কয়েকটা বাড়ি থেকে নারী কণ্ঠের কান্না বাতাসে ভেসে এলো। ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। কান্নায় আকাশ ভেঙে পড়বে যেন। কান্না শুনে বুকের মধ্যে শোক যেন তোলপাড় করে উঠে আসছে।

আজু মোড়লের বাড়িটাও কবরের মতো নীরব। বাড়ির পশ্চিম পাশে বাঁশ বাগান আর ঘন ঝোপঝাড়। মোড়ল বংশের বহু কালের কবরখানা। কবরের গর্ত ঝোপঝাড়ের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। আজু মোড়লের বাইরের উঠোন থেকে বুঝা যায় বহুকালের পুরানো কবরের চিহ্ন। পূর্ণ দফাদার বাড়ির মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালো। সদ্য সন্তানহারা আজু মোড়লের বউ ঘরের দরোজায় বসে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ও বাবা-বাবা আমার বুকের মানিক কনে পাবোরে- ও বাবা, বাবা- নাড়ী ছেঁড়া সন্তানের শোকে মা জননীর কান্নায় উঠোনটা ভরে উঠলো। আজু মোড়ল গালে হাত দিয়ে গম্ভীর হয়ে ঘরের বারান্দায় বসে রয়েছে। পূর্ণ দফাদার আজু মোড়লের পাশে গিয়ে বসলো। শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেও সে কেঁদে ফেললো।

আজু মোড়লের দু'চোখ ভেঙে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। কন্ঠ অন হয়ে এসেছে। ঝিম মেরে বসে রইল পূর্ণ দফাদার। ডান হাত দিয়ে আজু মোড়লের মাথায় হাত রেখে নীরবে সান্ত্বনা জানাতে লাগলো।

দুপুরের সূর্য পশ্চিমের দিকে হেলে পড়েছে। ঘরের ছায়াটাও একটু একটু লম্বা হয়ে যাচ্ছে। পূর্ণ দফাদার বললো, কেঁদে কি করবা মোড়ল, সবই ভগবানের ইচ্ছা। আজু মোড়ল বললো, আমার মৃত্যুর পর এই বংশের ভিটের কেউ বাতি জ্বালা না।

- সবই ভগবানের ইচ্ছা। পূর্ণ দফাদার সান্ত্বনা জানালো।
আজু মোড়ল মাথা ঝাঁকালো। কোনো কথা বললো না।

- বাড়িতে বসে থেকে কী করবা মোড়ল?

- কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না দফাদার। দুদিনের মধ্যেই শরীরটা অর্ধেক শুকিয়ে গিয়েছে আজু মোড়লের। শক্ত বলিষ্ঠ দেহটা ভেঙে পড়েছে। এখনো দেহের অভ্যন্তরে ভাঙচুর চলছে। চোখ দুটো চলে গেছে গর্তের মধ্যে। কেমন যেন একটা বিষণ্ণতা তাকে গ্রাস করছে।

পূর্ণ দফাদার বললো, কোনো চিন্তা করো না মোড়ল, ভগবানের উপর আস্থা রাখো। তিনিই জানেন, এই জন্ম-মৃত্যুর রহস্য। এখানে মানুষের কোনো হাত নেই। তিনিই নাচাচ্ছেন, তিনিই হাসাচ্ছেন। তিনিই কাঁদাচ্ছেন। মানুষ তার হাতের পুতুল। তিনিই পড়ছেন। তিনিই ভাঙছেন। করবাড়া কী? এর বিরুদ্ধে মানুষের কিছুই করার নেই। হাসি কান্না আনন্দ শোক তাপ – এটাই নিয়ে মানুষের সংসার। এখন কীভাবে বেঁচে থাকব- এই নিয়ে ভাবতে হবে। ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন। এসো, আমরা তার কাছে প্রার্থনা করি। আজ আমরা মন্দিরে সন্ধ্যেবেলা ঈশ্বরের নামযজ্ঞ করার সিদ্ধান্ত নেব। তুমিও তো এই গ্রামের মোড়ল, তোমারও তোমাদের ধর্মমতে তার উদ্দেশ্যে একটা কিছু করো। আমরা বালাই দেবীর হাত থেকে রক্ষা পেতে চাই। যারা মারা গেছে- তাদের আত্মার মঙ্গ কামনা করি। ঈশ্বর যেন তাদের শান্তিদান করেন। 

আজু মোড়ল পূর্ণ দফাদারের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। ধীর স্থির কন্ঠে সান্ত্বনা বাক্য শুনিয়ে যাচ্ছে পূর্ণ দফাদার।

আমার পূর্ব পুরুষেরা আজ কোথায়? তাদের ছায়াও নেই। তাদের প্রতিনিধি হয়ে আমরাই বেঁচে আছি। একদিন আমরাও থাকব না। আমি যাব শ্মশানে, তুমি যাবে কবরে। কোনো পার্থক্য নেই। কঙ্কাল মাটিতে পচে যাবে। কেউ থাকবে না। মোড়ল- সবই ভস্ম হয়ে যাবে। এর জন্যে এত মায়া কেন? তোমার সন্তানের জন্যে মায়া, আমার সন্তানের জন্য মায়া এই মায়া ক্ষণিকের।

আজু মোড়ল দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ওর ডান হাতটা নিজের কোলের মধ্যে টেনে নিল।

পূর্ণ দফাদার। তুমি চিন্তা করো না মোড়ল। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। তোমায় শক্তিদান করুন। তিনিই সহায়। তিনিই প্রতিপালক। তোমার জন্যে কী পুরস্কার আছে- তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে।

পূর্ণ দফাদার উঠে দাঁড়ালো। বারান্দা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো সে। আকাশ সূর্যকিরণে ঝকমক করছে। মনে হলো আগুন ঝরছে আকাশ থেকে। বাতাসও গরম হয়ে উঠেছে। মাথাটা নিচু করে পূর্ণ দফাদার ঝলসানো আগুনের মধ্য দিয়ে হাঁটতে লাগলো।

গৃহে গিয়েও মনটা আনচান করতে লাগলো। দুর্ভাবনা পাকিয়ে পাকিয়ে মাথার খোড়লে এসে ঢু মারছে। হঠাৎ পাড়ার মধ্যে একজন মহিলার কান্না শোনা গেল। কান দুটো খাড়া হয়ে উঠলো পূর্ণ দফাদারের। শাস্তারানি কাছে এসে দাঁড়ালো। চোখে মুখে একটা দুর্ভাবনার ছাপ।

পূর্ণ দফাদার জিজ্ঞেস করলো, এই দুপুর বেলা আবার কে মারা গেল? কিছুক্ষণ আগেই মারা গেছে পুতলির মা। মরার বাড়িতে কোনো লোকজন নেই । ভয়ে কেউ ও মুখো যাচ্ছে না- শান্তারানি বললো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো পূর্ণ দফাদার। বীরেন দত্তের বউ সুধারানিকে সবাই পুতলির মা বলে ডাকে। পুতলি হচ্ছে সুধারানির মেয়ে। মেয়েটা ধিঙ্গি হয়ে উঠেছে। বিয়ের যোগ্য হয়ে উঠেছে। বিয়েরও দিনক্ষণ পড়েছে। কয়েকদিন পরেই বিয়ে। সকাল বেলা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল পুতলির মা। দুপুর হতে না হতেই শেষ। এখন বউটার শিয়রে বসে গালে হাত দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছে বীরেন দত্ত।

খবরটা শুনে শান্তারানি ও-পাড়া মুখো যায়নি। মুখ কালো করে ঘরে বসেছিল। কেমন যেন একটা অজানা ভীতি মাথার ভেতর ভর করেছে। পূর্ণ দফাদার শান্তারানির মুখের দিকে হতাশ হয়ে তাকিয়ে রইল।

শান্তারানি বললো, এক দণ্ডও এই বাড়িতে আমার মন টিকছে না। আমার বাবার বাড়িতে গিয়ে কালকেই রেখে এসো। আমার জলা ও দিনকেও সঙ্গে নিয়ে যাব। বালাই ষাট। বালাই ষাট। ভগবান, তুমি মঙ্গল করো। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আসছে শান্তারানির গলা।

দমমেরে অনড় পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল পূর্ণ দফাদার। মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করছে। শরীরটা হিম হয়ে আসতে লাগলো। মনে হলো হৃৎপিণ্ডটাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

শান্তারানি বললো, সেই সকাল বেলা বেরিয়েছ এতক্ষণ ছিলে কোনখানে? পূর্ণ দফাদার কোনো জবাব দিল না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চক্রবর্তী পাড়া থেকে একটা ধ্বনি ভেসে আসছে। হরিবোল হরিবোল ধ্বনিটা ক্রমান্বয়ে জোরালো হয়ে উঠছে। ধ্বনিটা বুকের মধ্যে ঢুকে ধাক্কা মারছে। তিন দিনের মধ্যে বিশজন খতম। মুসলমান পাড়া থেকে গেছে বারো। হিন্দু পাড়া থেকে গেছে আট। আরও যে কতজন যাবে, ইয়ত্তা নেই। শান্তারানি আবার বললো, কাল কিন্তু সকাল বেলা ট্রেনে করে আমারে তুমি গোবরডাঙ্গায় বাবার বাড়িতে রেখে আসবা। এখানে থাকতে আমার একটুও মন চাচ্ছে না। মড়ক লেগেছে। গ্রামটা ছয়লাব হয়ে যাচ্ছে। হাওয়া যখন একবার গ্রামে ঢুকেছে- তখন ক্ষতি তো করবেই। বলো, বলো, রেখে আসবে কিনা?

পূর্ণ দফাদার একটু নড়ে চড়ে উঠলো। শান্তারানি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে বললো, লক্ষণ ভালো বলে মনে হচ্ছে না। আজ ক'জন গেল। পরশু কয়েকজন গেল । আগামীকাল দেখবা আরও কয়েকজন যাবে। চলো, কয়েকদিন গোবরডাঙ্গায় গিয়ে আমরা থাকি। তারপর পরিস্থিতি ভালো হলে চলে আসব। পূর্ণ দফাদারকে হাত ধরে টানতে টানতে ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল শান্তারানি।


তিন

দুটো দিন পার হয়ে গেল। তারপর তৃতীয় দিনে বাড়িতে গ্রামের মুসল্লিদের ডেকে এনে মিলাদ দিলো আজু মোড়ল। মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যে দোয়া দরুদ পাঠ করা হলো। তবুও মনে হলো, মৃতের আত্মা সারা বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

উঠোনে খেলে বেড়াচ্ছে খোকা। বারান্দায় বসে আছে খোকা। ঘরের মধ্যে শুয়ে আছে খোকা। সারারাত ঘুম হলো না আজু মোড়লের। পরের দিন সকাল বেলা উঠে সে ফজরের নামাজ পড়লো। দোয়া দরুদ পাঠ করলো। দুই হাত জোড় করে মোনাজাত করলো। তারপর তসবি টিপতে টিপতে কবরখানায় গিয়ে খোকার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলো সে। বুকের ভেতর থেকে কান্না উতলে উতলে উঠছে। চোখ ফেটে অশ্রু দু'গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। বাড়ির সন্নিকটেই ঝোপঝাড়ের মধ্যে পূর্বপুরুষের কবরখানা। মোড়ল বংশের বহু পুরুষ শুয়ে আছে এখানে। মাত্র তিন পুরুষের নাম জানে আজু মোড়ল। তকি মোড়ল । জসি মোড়ল। জসি মোড়লের ছেলে তুবন মোড়ল । তুবন মোড়লের ছেলে রাজু মোড়ল। রাজু মোড়ল বাইশ বছর বয়সে ইন্তেকাল করে। রাজু মোড়লের মৃত্যুর পর জন্য হয় আজু মোড়লের। ভূবন মোড়লের দুই ছেলের মধ্যে কনিষ্ঠ সন্তান হলো আজু মোড়ল। আজু মোড়লের ছিল একটি মাত্র পুত্র। সেও কয়েকদিন আগে কবরবাসী হয়েছে। কবরের সামনে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো আজু মোড়ল।

দুপুর বেলা। ফাল্গুনের রোদ কিছুটা তেতে উঠেছে। গাড়িতে খড়ের বোঝা চাপিয়ে গ্রামের দিকে যাত্রা করলো রাজুরা ক্যাচর ক্যাচর করে গাড়ির ঢাকা থেকে শব্দ উঠে আসছে। ধুলো উড়ছে বাতাসে। মিশ্রী দেয়াড়া পার হয়ে হাড়িয়া দেয়াড়া গ্রামের মধ্যে ঢুকলো ওরা। কয়েকজন গাড়োয়ান মনের সুখে গান ধরেছে।

বাপ ভুবন মোড়ল ছিলেন এই নিগরের একজন প্রতিপত্তিশালী লোক। তাকে সকলেই মান্যগণ্য করতো। আশেপাশের দগ্রামের লোক তাকে কদর করতো। লোকটা চাষাভুষো হলে কি হবে? সততা ও সাহসের গুণে তিনি ছিলেন প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী। হিন্দু ও মুসলমানরা তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতো।

যেবার জিংস সাহেব প্রথম নীলের কারখানা বানালেন এ গ্রামে, সেবার এই গ্রামে এসে তিনি প্রথম সাক্ষাত করেছিলেন ভূবন মোড়লের সঙ্গে। লোকমুখে তার নাম জেনেছিলেন জিংস সাহেব। একদিন সরাসরি জিংস এবং ম্যাকেঞ্জি সাহেব বিকেল বেলা গ্রামটা ঘুরতে ঘুরতে এসে উপস্থিত হলেন ভুবন মোড়লের বাড়িতে। পাঁচিলের বাইরে দাঁড়িয়ে একজন নেটিভকে বললেন, বাড়ির মালিকের সঙ্গে একটু পরিচিত হতে চাই। তাকে আমরা একটু সেলাম জানাবো।

খবর শুনে ভুবন মোড়ল সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালেন। লোকটা কালো বটে কিন্তু চেহারায় একটা জৌলুস রয়েছে। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা। চাছা ছোলা শরীর। বুকটা চওড়া। কাঁধটা একটু উঁচু। মুখে দাঁড়ি গোঁফ। কোমরটা সরু। পরনে সাদা ধুতি। হাঁটু এস্তেক লম্বা। গায়ে হাতাকাটা ফতুয়া। দেখলেই বুঝা যায় গায়ে গতরে বলিয়ান । সোজাসুজি সাহেবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাত উঁচু করে আদাব জানালেন ভুবন মোড়ল, সাহেব সেলাম।

জিংস সাহেব এবং ম্যাকেঞ্জি সাহেব বাহু বাড়িয়ে করমর্দন করলেন; সেলাম, সেলাম, দেখা করতে এসেছি। আমরা তোমার বহুত নাম শুনেছি মোড়ল- জিং সাহেব বললেন। তুবন মোড়ল হাসলেন। দহলিজ ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। বুঝলেন, ভুবন মোড়ল সংগতি সম্পন্ন লোক। এই দিগরে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে তার সাহায্য ও সহযোগিতা বিশেষ দরকার।

মোড়ল, আমরা তোমার সঙ্গে আলাপ করে খুশি হয়েছি। তুমি খুব সাচ্চা লোক মোড়ল। তোমার সঙ্গে আমাদের দোস্তি হয়ে গেল। আমরা তোমাকে আমাদের কাজের সহযোগিতা করার জন্যে আহ্বান জানাচ্ছি।

তুবন মোড়ল বললেন, ঠিক আছে সাহেব, আপনাকে অসংখ্য সেলাম। এই হতভাগাকে মনে করে- আপনারা আমার নিবাসে এসেছেন, এরজন্যে হাজার সেলাম।

কয়েকদিনের মধ্যেই জিংস এবং ম্যাকেঞ্জি সাহেবের সাথে ভুবন মোড়লের দোস্তি হয়ে গেল। দুই সাহেবের একান্ত সহচর হয়ে উঠলেন ভুবন মোড়ল। এলাকায় তিনিও পরিচিত হয়ে উঠলেন ভূষন সাহেব বলে। 'মোড়ল' পদবির বদলে 'সাহেব' পদবিতে ভূষিত হলেন। এতে তার কদরও বেড়ে গিয়েছিল। ম্যাকেঞ্জি সাহেবের তিনি এত প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলেন যে, যেখানেই ম্যাকেঞ্জি সাহেব গমন করতেন, সেখানেই দেখা যেত তুৰম সাহেবকে।

শেষ পর্যন্ত সাহেবদের সঙ্গে ভুবন মোড়লের দোস্তি টিকে থাকেনি। ১২৬৭ বাংলা সনে এলাকায় যে কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয়, এই বিদ্রোহে ভূবন মোড়ল কৃষকদের পক্ষাবলম্বন করেন এবং নেতৃত্ব দেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে, স্থানীয় রায়তগণ সাহেবদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে উত্তেজনা প্রকাশ করছে। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে দল বেঁধে সাহেবদের আস্তানা ধ্বংসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তেই রায়তরা সঙ্গবদ্ধভাবে নীলের গোলায় আগুন দিতে পারে। এমন একটি পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে যে অধিকাংশ চাকর চাকরানি আতঙ্কে সাহেবদের আস্তানা থেকে ভেগে গিয়েছে। বাজারে গিয়েও সাহেবরা খাদ্যবস্তু খরিদ করতে পারছে না। সমগ্র যশোর জেলায় চলছে রায়তদের বিপ্লব।

অতি সত্ত্বর ভুবন সাহেব থেকে আবার তুবন মোড়লে পরিণত হলেন। মোড়লের বয়স তখন পঁচিশ। এর মধ্যে এক পুত্র সন্তানের জনক হয়েছেন। পনেরো বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন। আঠারো বছর বয়সে হয়েছেন জনক। সাত বছরের ছেলেটা যখন চৌদ্দ বছরে পদার্পণ করলো, তখন তাকে বিয়ে করান। অপরূপ সুন্দরী ছিলো মেয়েটা। বিশ্বের আট বছর পরেই হঠাৎ করে মারা গেল ভুবন মোড়লের রাজু ছেলেটি। ডহর মাগুরায় খড় আনতে গিয়েছিল রাজু। সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল পাঁচটি গরুর গাড়ি। বাড়িতে ছিল গরুর বাথান। ফি বছর গোয়াল ঘরটি নতুন খড় দিয়ে ছাওয়া হতো। যে ঘরটিতে খড় রাখা ছিল, তার এক পাশে ছিল মা কালীর মূর্তি। মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে রাজু খড়ের আঁটি টানাটানি করছিল। কে একজন বললো, মূর্তির গায়ে পা লাগিয়ে খড় টেনে আনতে যদি পারো, তা হলে বুঝব তোমার সাহস আছে।

- রাজু হাসলো। এতে আবার সাহসের কি?
- আছে! আছে! আছে! ভূত প্রেতের ভয় আছে।
- আমি বিশ্বাস করিনে। ভূত প্রেত বলে কোনো বস্তু আছে কিনা। কালী হচ্ছে অমঙ্গলের মূর্তি।

মূর্তিটাতো মাটি দিয়ে তৈরি। এটা তো জীবন্ত কোনো প্রাণী নয়। মানুষ কেন একে ভয় করবে? হো হো করে হাসলো রাজু।

কথা বলতে বলতে খড়ের আঁটি ধরার উদ্দেশ্যে মূর্তিটার উপরে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে। মূর্তিটা ওর দেহের চাপে একদিকে কাত হয়ে গেল। টাল সামলাতে না পেরে পা ফসকে মাটিতে পড়ে গেল রাজু। মূর্তিটা হুড়মুড় করে ওর বুকের উপরে এসে পড়লো। মনে হলো কে যেন ওকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। শরীরটা ছম ছম করে কেঁপে উঠল।

সকলেই ধরাধরি করে টেনে তুললো রাজুকে। রাজু উঠে দাড়ালো। এইভাবে যে মূর্তিটা ভেঙে পড়বে, রাজু বুঝতেই পারেনি।

দুপুর বেলা। ফাল্গুনের রোদ কিছুটা তেতে উঠেছে। গাড়িতে খড়ের বোঝা চাপিয়ে গ্রামের দিকে যাত্রা করলো রাজুরা ক্যাচর ক্যাচর করে গাড়ির ঢাকা থেকে শব্দ উঠে আসছে। ধুলো উড়ছে বাতাসে। মিশ্রী দেয়াড়া পার হয়ে হাড়িয়া দেয়াড়া গ্রামের মধ্যে ঢুকলো ওরা। কয়েকজন গাড়োয়ান মনের সুখে গান ধরেছে।

দেহটা ছিল দেখবার মতো। পাকা ছয় হাত লম্বা। চওড়া বুক। উঁচু কাঁধ। পেশীবহুল শরীর। মাথায় বাবরি চুল। ঘন কালো লম্বা চওড়া গোফ। লম্বা জুলফি। গায়ের রঙ গোলাপী। এমন জোয়ান মরদ এলাকায় দ্বিতীয়টি নেই।

রাজুর গাড়িটা আগে আগে চলেছে। রাজু অনুভব করতে লাগলো তার তলপেট থেকে চিনচিন করে একটা ব্যথা বুকের দিকে ঠেলে উঠছে। আস্তে আস্তে ব্যথাটা বাড়ছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে রাজুর। আরও জোরে গাড়ি চালাতে লাগলো গাড়োয়ানরা।

বাড়িতে পদার্পণ করতে না করতেই ভেদ বমি শুরু হয়ে গেল রাজুর। দলাদলা রক্ত গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো। গ্রাম থেকে ফকির কবিরাজ ডেকে আনা হলো। ঝাড়ফুঁক, তেল পড়া, পানি পড়া করা হলো। সন্ধ্যা হতে না হতেই খতম। আজু মোড়ল সারিসারি কবরের দিকে বোবার মতো তাকিয়ে রইল। একদিকে বাপের কবর, তার পাশে ভাইয়ের কবর। কবর দুটো ভেঙে পড়েছে। কবরের দুপাশে ঝোপঝাড় গজিয়েছে। তারপর মা জননীর কবর। মায়ের কবরের পাশে শুয়ে আছে তার বারো বছরের খোকা। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো। বুকের ভেতর থেকে গুমরে গুমরে কান্না বেরিয়ে আসতে লাগলো।

ভোরের কুয়াশা জড়ানো অন্ধকারে একাকী দাঁড়িয়ে রইল আজু মোড়ল। সে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, বাপজান, তোমার পাশে রেখে গেলাম খোকাকে। মা জননী, তোমার কোলের কাছেই রেখে গেলাম আমার খোকাকে। ও আমার ভাই, তুমিও যেভাবে ইন্তেকাল করেছিলে, আমার খোকাও ইন্তেকাল করেছে সেভাবে, তোমাদের সকলের পাশাপাশি তাকেও আজ রেখে গেলাম। ভাইয়ের মৃত্যুর মতো নিজের ছেলেরও মৃত্যু হয়েছে। ভাই বাইশ বছর অবধি দুনিয়ার আলো বাতাস উপভোগ করেছিলো। খোকা সেটুকু জীবনও পায়নি। এগারো বারো বছরে অকালেই জীবনটা তার ঝরে গেছে। শোকে আজু মোড়লের বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগলো। কবরখানা থেকে বেরিয়ে এলো আজু মোড়ল।

ভোরের অন্ধকার ফিকে হয়ে আসতে লাগলো। আস্তে আস্তে হেঁটে এসে বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালো। সারা বাড়িটা নির্জনতায় আচ্ছন্ন। চাষ কাজের জন্যে দুজন মাইনদার রেখেছিল। মহামারির দাপট দেখেই রাতের বেলা তারা কয়েকদিন আগে এই বাড়ি থেকে চম্পট দিয়েছে। ছাগল, গরু চরায়ে নিয়ে বেড়াত একজন রাখাল বালক। খোকার ইস্তেকালের পরদিন থেকে একেবারে হাওয়া হয়ে গেছে সে। কোথায় যে মৃত্যু ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তাও খোঁজ নিতে পারেনি আজু মোড়ল। কবরখানা থেকে ফিরে এসে গোয়াল ঘরে ঢুকলো আজু মোড়ল। বড়ো বড়ো বেশ কয়েকটি লাঙলের দামড়া গরু বাঁধা রয়েছে। গাই গরু আছে পাঁচটি। এর মধ্যে দুটো গাই দুধ দিচ্ছে। আটটি দামড়া গরু এবং দুটো গাই গরুর গলা থেকে দড়ি খুলে দিলো আজু মোড়ল। গরুগুলো গোয়াল ঘর থেকে বেরিয়ে গেল পা ঠুকতে ঠুকতে।

দুধওয়ালা গাই দুটোর গলার দড়ি টানতে টানতে বাইরের উঠোনে এনে দুটো বাঁশের খুঁটিতে বাঁধলো আজু মোড়ল। এই পাই গরুর পেছনে পেছনে ঘুরতো খোকা। আজু মোড়লের বিধবা বড়ো বোন দুবেলা দুধ দুয়ে নিত। নিকটে দাঁড়িয়ে দুধ দোয়া দেখতো এগারো বারো বছরের ছেলেটা। প্রতিদিন দুধ পান করা তার নেশা হয়ে গিয়েছিলো। গায়ে গতরেও বাড়ন্ত হয়ে উঠেছিলো সে। সকাল বেলাটা সে কাটাতো হইচই করে। এখন কোনো হইচই নেই। কোনো কোলাহল নেই। বাড়িটা একেবারে নিস্তব্ধ । বড়ো বোন ছফুরা বিবিরও ব্যতিব্যস্ততা নেই। খোকাকে দুধ খাওয়ানোর জন্যে তাড়াহুড়া নেই। কমলি বাছুর নিয়ে টানাটানি নেই। দুধ দোয়ার কাজটি আপাতত বন্ধ। বাছুর দুটো ছাড়া পেয়ে উঠোনে লাফালাফি করে বেড়াচ্ছে। ভোরের স্তব্ধতা ভাঙছে কমলি বায়ুরের ছুটে বেড়ানোর শব্দে।

একটু পরে আড়মোড়া ভেঙে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে দাঁড়ালো ছফুরা বিবি। তাকিয়ে দেখলো, আজু মোড়ল লাঙল ঘাড়ে করে দুটো দামড়া গরু নিয়ে নীরবে মাঠের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। ছফুরা বিবি পেছন থেকে ডাকলো। ফিরে তাকালো না সে। হ্যাট হ্যাট শব্দ করে গরু দুটো তাড়িয়ে নিয়ে গেল মাঠের দিকে। এমন অন্যমনস্ক হয়ে আছে যে, ছফুরা বিবির ডাক তার কানেই ঢুকেনি। খোকার ছায়াটা তার চোখে ভাসছে।

চারদিকে হাল্কা পাতলা কুয়াশা। সেই কুয়াশা ভেদ করে হেঁটে যেতে লাগলো আজু মোড়ল। চৈত্র মাসের খরখরে ডেলার উপর দিয়ে যতই হাঁটছে সে, ততই তার চোখের উপরে ভাসছে খোকার ছায়া। আগে আগে হেঁটে যাচ্ছে ছায়া। মনে হলো, ছায়া নয়- খোকা হেঁটে যাচ্ছে। সে যেদিকেই তাকাতে লাগলো, সেদিকেই দেখতে লাগলো খোকাকে। খোকা হাঁটছে। তার পায়ের শব্দ উঠে আসছে। ডানে হাঁটছে খোকা। বাঁয়ে হাঁটছে খোকা। পেছনে হাঁটছে খোকা। সামনে হাঁটছে খোকা।

হাঁটতে হাঁটতে নিজের ভুইয়ের উপর এসে দাঁড়ালো আজু মোড়ল। চোখের মধ্যে তখনও ঘোর লেগে আছে। মনে হলো, কুয়াশা জড়ানো এই মাঠে খোকা দাঁড়িয়ে রয়েছে। সারা মাঠ যেন খোকা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পৈতৃকসূত্রে এই জমির মালিক আজু মোড়ল । বাবা ভুবন মোড়ল ছিলেন একজন গাঁতিদার। অনেক বিষয় সম্পত্তির মালিক ছিলেন তুবন মোড়ল। একমাত্র পুত্র রাজু মোড়লের অকালে মৃত্যু হওয়ায় তিনি মানসিকভাবে বিপর্যন্ত হয়ে পড়েন। সংসারের প্রতি তার কোনো টান ছিল না। পীর মুর্শেদদের দরগায় দরগায় গিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। তার মনে বৈরাগ্য দেখা দিয়েছিল। অনেক ভূসম্পত্তি তিনি এই সময় বেহাত করে ফেলেছিলেন। জীবনটাকে তিনি অসার বলে মনে করতেন। জমি বেহাত হতে হতে যখন শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়ালো, তখন জন্ম হলো আজু মোড়লের। ভূবন মোড়লের বয়স তখন পঁয়ষট্টি বছর।

সংসারটা আবার সোজা হয়ে উঠলো। মেরুদও খাড়া করে দাঁড়ালেন ভুবন মোড়ল। সদ্যভূমিষ্ঠ নবজাত শিশুর মুখ দেখে পুলকে তিনি আত্মহারা হয়ে উঠলেন । ছেলের নাম রাখলেন আরজু মোড়ল। আল্লাহর কাছে আরজ করে পুত্র। সন্তান লাভ করেছিলেন বলে নবজাত শিশুর নাম রেখেছিলেন আরজু। লোকে তাকে আজু নামেই ডাকতো। আজুর জন্মের দশ বছর পরে ইন্তেকাল করেন তুবন মোড়ল। সংসারটা আবার বেহাল অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ালো। অভিভাবকশূন্য হয়ে উঠলো মোড়ল পরিবার। সংসারে নানারকম সমস্যা দেখা দিতে লাগলো। আত্মীয় স্বজনরা সম্পত্তির লোভে ফ্যাসাদ তৈরি করতে লাগলো। এসব ঝুট ঝামেলা মোকাবেলা করা আজুর মায়ের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি কয়েক মাসের মধ্যে পরিস্থিতি উপলব্ধি করে আপন বোনের মেয়ে ছফুরা এবং তার স্বামী আতিক উল্লাহকে নিরুপায় হয়ে নিজের সংসারে এনে রাখলেন।

আতিকউল্লাহ ছিলেন অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি। বৈষয়িক বিষয় সম্পর্কে ছিলেন। অভিজ্ঞ। কয়েকমাসের মধ্যেই সংসারের হাল অবস্থার মোড় ঘুরিয়ে ফেললেন। সংসারটা পুরোপুরি খাড়া হয়ে উঠলো। আতিকউল্লাহ হয়ে উঠলেন মোড়ল। বাড়ির মোড়ল। আজু মোড়লের মা তাকে নিজ সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। আতিকউল্লাহ্ তাকে মা বলে ডাকতেন। অল্পদিনের মধ্যেই এই গ্রামের একজন মানীগুণী লোক হয়ে উঠলেন আতিকউল্লাহ্। তার বংশ পদবি অবশ্য মোড়ল ছিল না। তিনি ছিলেন দশ পাকিয়ার বিশ্বাস পরিবারের ওয়াজেদ আলি বিশ্বাসের দশ ছেলের মধ্যে পঞ্চম ছেলে। এই দিগরে বিশ্বাস পরিবারের একটা নামডাক ছিল। খ্যাতি প্রতিপত্তি ছিল। নিজের কর্মগুণে এই এলাকায়ও আতিকউল্লাহ্ সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরই ছিলেন তিনি প্রিয়ভাজন।

আসলে আতিকউল্লাহ্ ছিলেন দৃষ্টিধারী লোক। দেহটা ছিল দেখবার মতো। পাকা ছয় হাত লম্বা। চওড়া বুক। উঁচু কাঁধ। পেশীবহুল শরীর। মাথায় বাবরি চুল। ঘন কালো লম্বা চওড়া গোফ। লম্বা জুলফি। গায়ের রঙ গোলাপী। এমন জোয়ান মরদ এলাকায় দ্বিতীয়টি নেই।

আতিকউল্লাহ্ আরও কয়েকটি গুণের অধিকারী ছিলেন। তিনি কৃষি কাজে যেমন দক্ষ ছিলেন তেমনই ছিলেন কুস্তি ও সড়কি খেলায় পারদর্শী। কোনো কিছুর প্রতি লোভ-লালসা ছিল না আতিকউল্লাহর। আজু মোড়লকে নিজ ভাইয়ের মতো করে দেখভাল করতেন। ছায়ার মতো আতিকউল্লাহ পেছনে ঘুরে বেড়াতো আজু মোড়ল। এক রকম সর্ব সময়ের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল আতিকউল্লাহ্।

আজুর বয়স পনেরো বছর হয়ে উঠলে চারদিক থেকে তার বিয়ের সম্বন্ধ আসতে লাগলো। মাও তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। আতিকউল্লাহ কয়েকটি জায়গায় গিয়ে কন্যা দেখে আসলেন। বিয়ের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা চলতে লাগলো। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন আতিকউল্লাহ্। গা কাঁপিয়ে জ্বর আসতে লাগলো। আশেপাশের কবিরাজদের ডাকা হলো। ওষুধ খেয়েও কোনো উপকার হলো না। যশোহর শহরেও নিয়ে যাওয়া হলো। সরকারি ডাক্তার বললেন, কালাজ্বর। এক বছরের মধ্যেই ইন্তেকাল করলেন আতিকউল্লাহ্। আর একটা শোকের ধাক্কা এসে লাগলো মোড়ল পরিবারে। ছফুরা বিধবা হয়ে গেলেন। কিন্তু স্বামীর পরিবারে আর ফিরে গেলেন না। থেকে গেলেন মোড়ল পরিবারে।

চলবে...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

ট্যাগ সমূহ

ঝিকরগাছার ইতিহাস, ঝিকরগাছা উপজেলার ইউনিয়ন, ঝিকরগাছা খবর, গদখালি ঝিকরগাছা, ঝিকরগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান, ঝিকরগাছা পোস্ট কোড, ঝিকরগাছা এমপি, ঝিকরগাছা আবহাওয়া, ঝিকরগাছা উপজেলা ম্যাপ, ঝিকগাছার ঐতিহ্য, পানিসারা, ঝিকরগাছা পৌরসভা, ঝিকরগাছা দর্শনীয় স্থান, ঝিকরগাছা বাজার।