তখন ছিল চৈত্রমাস
এক
চৈত্র মাসের খর দুপুরে ভুঁই চাষ দিয়ে লাঙলটা ঘাড়ে করে সবেমাত্র রাস্তায় উঠেছে, দামড়া গরু দুটো শিং বাঁকিয়ে আগে আগে হাঁটছে, হঠাৎ পেছন থেকে ক্রিং করে আওয়াজ উঠলো একটা। গরু দুটো লাফ মেরে ডানদিকে সরে গেল। একজন সাইকেল আরোহী তাল সামলাতে না পেরে আজু মোড়লের ঘাড়ের উপরে হুড়মুড় করে পড়ে গেল।
কে জানত বিপদটা এইভাবে আসবে? আজু মোড়ল তাকিয়ে দেখলো, ধুতি পাঞ্জাবি পরা একজন বাবু লোক। এবড়ো-থেবড়ো রাস্তার ধুলোর উপরে গড়িয়ে পড়েছে। লাঙলটা ঘাড় থেকে নামিয়ে বাবু মশায়ের দিকে ছুটে গিয়ে হাত ধরে টেনে তুললো। বাম পায়ে একটা আঘাত পেয়েছে লোকটা। চামড়া ছিঁড়ে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসেছে। গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বাবুমশায় চোখ পাকিয়ে গালি দিতে লাগলো।
- হারামজাদা, লাথি মেরে তোর বুক ভেঙে দেব। বাবার রাস্তা পেয়েছো, তাই না? পেছনে কে আসছে আর না আসছে, দেখে চলতে পারো না?
আজু মোড়ল বাবু মশায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই মেঠো পথ দিয়ে গ্রামের চাষাভুষোরা কেবল চলাফেরা করে। এটা কোনো বাবু লোকের যাতায়াতের পথ নয় । কী করে সে জানবে এই পথ দিয়ে দুই চাকার গাড়ি হাঁকিয়ে একজন শহুরে বাবু ভ্রমণ করতে আসবেন। লোকটাকে চিনতে পারলো না আজু মোড়ল। আশপাশে প্রায় সব গ্রামের লোককে চেনে সে। কিন্তু এই লোকটিকে কোথায়ও দেখেছে বলে মনে পড়লো না। এই দুর্ঘটনার জন্যে সে একটুও দোষী নয়। লোকটা তবুও হিংস্র বাঘের মতো চোখ দু'টো লাল করে অনবরত গালি ছুড়তে লাগলেন।
- হারামজাদা, তোর নামে থানায় গিয়ে মামলা ঠুকে দেব। ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেব। আমার বাম পা-টা জখম করে দিয়েছিস। এর জন্যে ক্ষতিপূরণ আদায় করে নেব। গোমূর্খ চাষা। আমার বাড়ি পর্যন্ত যদি না পৌছিয়ে দিস, তবে তোকে মজা দেখিয়ে ছাড়ব হারামজাদা।
- গ্রামের রাস্তার ধারেই আজু মোড়লের বসতবাটী। গ্রামটা কয়েকদিনের মধ্যে প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে। ওলাওঠা রোগ দেখা দিয়েছে। এমন কোনো দিন নেই যে, মানুষ মরছে না। সারা এলাকা জুড়ে দেখা দিয়েছে মৃত্যু-বিভীষিকা। গ্রাম থেকে মানুষজন পালিয়ে যাচ্ছে।
গতকাল আজু মোড়লের বারো বছরের ছেলেটাও ওলাওঠায় মারা গিয়েছে। ভোর রাতে ভেদবমি আর পাতলা বাহ্য শুরু হয়েছিল। দুপ্রহর পার না হতেই আজরাইল জানটা কবজ করে নিয়ে গেছে। একমাত্র ব্যাটা ছেলেকে হারিয়ে আজু মোড়ল শোকে পাথর হয়ে আছে। বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। এখনো বুকের মধ্যে থেকে ঠেলে ঠেলে বেরিয়ে আসছে দম আটকানো কান্না। এরই মধ্যে আবার এই ঘটনা। রাস্তায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল আজু মোড়ল।
এই ব্যাটা চাষা, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস ক্যান? আমার সাইকেলটা তোল । আজু মোড়ল কোনো জবাব দিলো না। ঝিম মেরে লোকটাকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। বাবু আরও ক্ষেপে উঠলেন। চোখ দুটো তার রাগে লাল হয়ে উঠেছে। যাচ্ছেতাই বলে অশ্লীল গালি ছুড়তে লাগলেন। তবুও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে সে। বাবুর তম্বিতম্বি আরও বাড়তে লাগলো। কোনো কিছুই কানে ঢুকছে না তার। মৃত ছেলেটার কায়া চোখের সামনে এসে ভাসছে। বোধজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে আজু মোড়ল। বাইরে থেকে বুঝার উপায় নেই যে, শোকে কাতর হয়ে আছে সে। আসলে অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে আজু মোড়ল।
- এই ব্যাটা, জবাব দিচ্ছিসনে ক্যান?
- কাল আমার ছাওয়াল মরে গেছে বাবু। মনটা ভালো নেই ।
- তাই বলে আমাকেও মরতে হবে নাকি?
- আমিতো ইচ্ছে করে ফেলে দিইনি। আপনিতো নিজেই পড়ে গেছেন।
- হারামজাদা, আমি কি মিছে কথা বলেছি? আমি তোর বিরুদ্ধে থানায় গিয়ে মামলা ঠুকর। কোমরে দড়ি বেন্ধে হাজতে ঢুকোবো। দিনদুপুরে রক্তপাত ঘটিয়েছিস। যদি তোকে হাজতে ঢুকোতে না পারি- তবে আমার নাম বদলে ফেলব। শুধু তাই নয়, রাস্তায় ফেলে দেয়ার জন্যে খেসারত আদায় করব। চিকিচ্ছে খরচও দিতে হবে, ব্যাটা নচ্ছার।
গ্রামের ভেতর থেকে বাতাসে ভেসে আসছে কান্নার আওয়াজ। বুকটা ধড়ফড় করে উঠলো আজু মোড়লের। মাথার উপরে চৈত্রের গনগনে রোদ। বাতাসে পাক খেয়ে ধুলোবালি উড়ে আসছে। দামড়া গরু দু'টো রাস্তা থেকে নিচে নেমে গিয়ে সদ্য গজানো ঘাস চিবিয়ে খেতে শুরু করেছে। গ্রামের ভেতর থেকে কয়েকজন চাষি এসে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলো।
পূর্ণ দফাদার বললো, বিত্তান্তটা কী?
বাবু মশায় বললেন, খুন, এই দুপুরে আমাকে খুন করে ফেলছিল ব্যাটা, পায়ে দেখ, রক্ত ঝরছে। এই ব্যাটাকে আমি ছেড়ে দেব না।
নরহরি বললো, এর জন্যে আবার ক্ষতিপূরণ কী? উনি তো ইচ্ছে করে কিছু করেন নি। গোলমাল পাকাবেন না বাবু, আপনার পা কেটে গিয়েছে, মোড়লকে আপনি শাসাবেন না বলছি। কাল উনার পুত্র মারা গেছে-
তা হলে একটা কাজ করো, আমাকে গরুর গাড়িতে করে আমার নিবাসে রেখে আসতে বলো। তা না হলে মামলা ঠুকে দেব।
আজু মোড়ল দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মাথার ভেতরে তালগোল পাকিয়ে পাকিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। একটার পর আরেকটা দুশ্চিন্তা এসে ঢুকছে। মনে হতে লাগলো হিম পাথরের মতো হয়ে যাচ্ছে ওর শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। পূর্ণ দফাদার বললো, মহাশয়ের নিবাস কোথায়?
বাবু বললেন, বসন্তপুর।
- মহাশয়ের নাম কী?
- তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
- গিয়েছিলেন কোথায়? স্বরূপকাটি-রায়গঞ্জ।
- দেখুন তারকবাবু, ঘটনা যখন একটা ঘটেই গেছে,
এখন চিল্লাচিল্লি করে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। কপালের লেখন খণ্ডাবে কে? আপনি মোড়লের উপরে যেভাবে দাঁত ঝাড়ছেন, এটা কিন্তু বিবেচনাসঙ্গত নয়।
তারকবাবু উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, আমি কি তা হলে এই রাস্তায় পড়ে থাকব? পূর্ণ দফাদার বললো, আপনিও বা আমাদের কি ভাবলেন, মামলা ঠুকবেন বলে ভয় দেখাচ্ছেন? আমাদেরও একটা মানমর্যাদা আছে!
তারকবাবু চুপসে গেলেন। মুহূর্তেই নিজেকে সংযত করে নিয়ে বললেন, আমার এখন উপায় কি?
নরহরি বললো, আপনার ব্যবহারে আমরা কষ্ট পেয়েছি। আপনি চাষাভুষো বলে মোড়লকে ধমকাচ্ছেন, এভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা ঠিক হয়নি। তারকবাবু বললেন, আমি কি এখানেই পড়ে থাকব? আমাকে জবাই করতে চান নাকি?
আজু মোড়ল বললো, ঠিক আছে, আপনাকে এখানে পড়ে থাকতে হবে না। আমি কথা দিচ্ছি, আপনাকে আপনার নিবাসেই রেখে আসব।
পূর্ণ দফাদার বললো, কি বলছ মোড়ল, কাল তোমার ছেলে মরেছে, এখনো শোকে তুমি মুহা। তুমি এই দুঃসময়ে কীভাবে উনাকে নিয়ে যাবে?
আজু মোড়ল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দুঃখের হাসি হাসলো। কপালের ফের, তা না হলে এই দুর্ঘটনা ঘটবে ক্যানো? তোমরা একটু সাহায্য করো, উনাকে সঙ্গে নিয়ে আমার বৈঠকখানায় তুলে দাও, আমি আমার কাপড়-চোপড় বদলে গরুর গাড়িতে করে রেখে আসব।
পূর্ণ দফাদার আর নরহরি দত্ত মিলে বাবু মশায়ের দুই বাহু ধরে দাঁড় করালো। আজু মোড়ল লাঙলটা ঘাড়ে করে গরু দুটো খেদিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো ।
কয়েক দিনের মধ্যে গ্রামটা শ্মশানের মতো হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিদিন এক একজন মরছে। গ্রামের ভেতর ঢুকতেই আর একটা মরা কান্নার ধ্বনি ভেসে এলো।
নরহরি আর পূর্ণ দফাদারের চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে উঠলো। পূর্ণ দফাদার জিগ্যেস করলো, কান্নাটা মনে হচ্ছে মাধব দত্তের বাড়ি থেকে ভেসে আসছে। হ্যাঁ, দাদা, সকাল বেলা শুনেছি খবরটা। কখন যে কার বাড়িতে গিয়ে ছোবল
মারছে- একটুও বুঝা যাচ্ছে না। নরহরির জিভটা আড়ষ্ট হয়ে এলো!
- তারক গঙ্গোপাধ্যায় জিগ্যেস করলেন, গ্রামে ওলাদেবীর আগমন ঘটেছে না কি?
- আজ্ঞে বাবু, গ্রামটা উলোট-পালোট করে দিচ্ছে।
তাহলে এখনি আমাকে আমার নিবাসে নিয়ে চলো। কি ভয়ঙ্কর বিপদে যে পড়েছি, ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করুন।
পূর্ণ দফাদার নরহরির মুখের দিকে তাকালো।
কান্নার স্বর আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। যে বাড়িতে মানুষ মরছে, সেই মরা মানুষটাকে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে যে দাহ করে আসবে, তেমন কোনো লোকও পাওয়া যাচ্ছে না। দুজনেরই চোখ বিষণ্নতায় স্থির হয়ে এসেছে।
বাবু মশায়কে ওরা দুজন ধরাধরি করে আজু মোড়লের বাইরের উঠোনে এনে দাঁড় করালো। একটা ঘূর্ণি বাতাস পাক খেয়ে খেয়ে উঠোনের পাশ ঘেঁষে মাঠের দিকে চলে গেল। রাম রাম বলে থুথুড়ি ফেলে দুহাত জড়ো করে একদিকে সরে দাঁড়ালো ওরা।
তারক গঙ্গোপাধ্যায় ঠকঠক করে কাঁপছেন। মুখের চেহারা বিবর্ণ। থ হয়ে তিনজন আজু মোড়লের বাইরের খোলেনে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। বাড়িটা বিশাল। ইটের পাঁচিল। পাঁচিলের ভেতরে দালান। দালানের কার্নিসে অশ্বত্থ গাছের চারা গজিয়েছে। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই কতকাল আগেকার বাড়ি। এই গ্রামের আদি অধিবাসীদের মধ্যে মোড়ল বংশ অন্যতম।
মোড়ল বংশ আদি হলেও বংশের বৃদ্ধি নেই। সহায় সম্পত্তি আছে কিন্তু লোকবল নেই। ফলে আজু মোড়লের ভিটেবাড়ি প্রায় জনশূন্য। সংসারে একজন বিধবা বোন আছে। বয়সে আজু মোড়লের বেশ কয়েক বছরের বড়ো। স্ত্রী আছে। সাত আট বছরের এক কন্যা আছে। একটি মাত্র পুত্র সন্তান ছিল। সবেমাত্র বারো বছরে পা দিয়েছিল। হঠাৎ গতকাল ভোরে ওলাওঠায় মারা গিয়েছে। বাড়িটি এখন শূন্য। হা-হা-কারে ভরে আছে।
আজু মোড়ল পাঁচিলের এক পাশে লাঙল রেখে বাড়ির সদর মহল থেকে অন্দর মহলে চলে গেল। বাইরে দহলিজ ঘর। বেশ ছিমছাম এবং সাজানো গোছানো। এক কোণে মাঝারি গোছের একটা তক্তপোশ। দেয়াল ঘেঁষে কয়েকটি হাতলওয়ালা চেয়ার। আত্মীয়-স্বজন কিংবা অতিথি এলে এই দহলিজ ঘরেই তারা উপবেশন করে। খোলেনের চারপাশে বড়ো বড়ো আম কাঁঠালের বৃক্ষ। দখিনের বাতাসে ঝরা পাতা আর খড়কুটো উড়ে আসছে। আজু মোড়ল বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে চেয়ারগুলো ঝেড়ে মুছে দিলো।
পূর্ণ দফাদার আর নরহরি তারক বাবুকে দহলিজ ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। তারকবাবু একটা চেয়ারে বসলেন। চোখে মুখে ত্রাসের চিহ্ন। সাইকেলটা দহলিজ ঘরের দেয়ালে কে একজন ঘাড়ে করে রেখে গেল।
ইতোমধ্যে পাড়ায় রটে গিয়েছে সাইকেল গাড়ির খবর। গ্রামের লোকেরা এর আগে কোনো দিন সাইকেল দেখেনি। লোক মুখে শুনেছে সাইকেল গাড়ির খবর। পাড়ার লোকেরা এই খবর শুনে হন্তদন্ত হয়ে আজু মোড়লের বাড়ির দিকে ছুটে আসতে লাগলো। দেখতে দেখতে উঠোনটা লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠলো। যেন আজব একটা চিজের আবির্ভাব ঘটেছে।
তারকবাবু বারবার তাগিদ দিতে লাগলেন, আরে, কতক্ষণ আমাকে এখানে বসিয়ে রাখবে তোমরা? আমার মেজাজ গরম হয়ে উঠছে। পূর্ণ দফাদার বললো, অত তাড়াহুড়ো করলে হবে না বাবু।
- তাহলে এখানে কি তোমরা আমাকে সারাদিন বসিয়ে রাখবে?
- আমরা তো বসিয়ে রাখিনি। পারেন তো নিজেই চলে যেতে পারেন।
আজু মোড়ল ঘর থেকে একটা থালায় করে চিড়ে, কলা ও গুড় নিয়ে হাজির হলো। বাবুকে উদ্দেশ্য করে বললো, এখন ভর-দুপুর, একটু খেয়ে নিন বাবু। না খেলে নিজেকে অপরাধী বলে মনে করব।
তারকবাবু জবাব দিলেন, আমি বামুন মানুষ। কোথাও কারোর বাড়িতে অন্ন স্পর্শ করি না। আমার সময় নষ্ট হচ্ছে। তুমি তাড়াতাড়ি করে আমাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো।
আজু মোড়ল বিনয়ের সঙ্গে বললো, আপনার বাড়িতে পৌঁছতে গিয়ে তো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। রাত হয়ে যেতে পারে।
পূর্ণ দফাদার বললো, হ্যাঁ, রাত হয়ে যেতে পারে। গ্রাম, খেদাপাড়া- বসন্তপুর, থানা মনিরামপুর, সেতো অনেক দূরের পথ। আমরা নদীর ঘাট পর্যন্ত নিয়ে যাব। আপনি নৌকায় উঠে সহজে যেতে পারবেন।
তারকবাবু বললেন, না। খুব বেশি দূরের পথ নয়। এখান থেকে গরুর গাড়িতে গেলে সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যাব। গ্রামের ধুলোমাখা ন্যাংটো ছেলে-মেয়েরা সাইকেলের কাছে দাঁড়িয়ে হইচই শুরু করে দিয়েছে।
আজু মোড়ল দহলিজ ঘর থেকে নেমে এলো। কি একটা ঝামেলায় সে জড়িয়ে পড়েছে, এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে মাথাটা বিগড়ে যাওয়ার মতো হয়ে উঠেছে। মনে হতে লাগলো, মাথা টলে মাটিতে পড়ে যাবে সে। দারুণ একটা মানসিক যন্ত্রণায় শরীর তার ভেঙে পড়ছে।
পূর্ণ দফাদার আর নরহরি দত্তও আজু মোড়লের পেছনে পেছনে নেমে এলো। একটা কাঁঠাল গাছের ছায়ায় এসে তারা দাঁড়ালো।
নরহরি বললো, আমি এই লোকটাকে এর আগে কখনো দেখি নি। তবে নাম শুনেছি।
পূর্ণ দফাদার বললো, আমিও ওর নাম শুনেছি। লোকটা সুদের কারবার করে। মানুষকে ফাঁদে ফেলে জমিজমা হাতিয়ে নেয়। ওর বিরুদ্ধে কেউ যদি প্রতিবাদ করে, তবে তার নামে মিথ্যা মামলা ঠুকে হাজতে ঢুকায়।
নরহরি বললো, হ্যাঁ, এই কারণেই তো বারবার থানা পুলিশের নাম করে ভয় দেখাচ্ছে। মোড়ল, যত কষ্ট হোক, এই পাপটাকে গরুর গাড়িতে করে ওর আস্তানায় নিয়ে গিয়ে রেখে এসো। তা না হলে ঝামেলা পাকাবে। পূর্ণ দফাদার মাথা ঝাকালো, হ্যাঁ, ওই পাপটা বিদায় নিলে সমস্ত ঝামেলা মিটে যায়। কোনো ঝুট ঝামেলা থাকে না।
নরহরি বললো, সামান্য একটু চামড়া ছিঁড়ে গেছে, তাই নিয়ে এত কাজ! আৰু মোড়ল বললো, আজ সন্ধ্যেবেলা আমার বাড়িতে মিলাদের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মসজিদের মুছুল্লিরা এসে দোয়া দরুদ পড়বে।
- তা হলে কি করবা তুমি? পূর্ণ দফাদার জানতে চাইল।
আজু মোড়ল বললো, এ রকম একটা ফ্যাসাদে পড়ব, ভাবতে পারি নি। একটা মুসিবতের পর আর একটা মুসিবত।
নরহরি বললো, আপদটা যে কন্ থেকে হাজির হলো বুঝতে পারলাম না। শালা, পড়বি না পড়বি তোমার ঘাড়ের উপরেই পড়েছে। গতবার আমার লাঙলের একটা দামড়া গরুর শিং ভেঙে গিয়েছিল, কিছুদিন পরে দেখি সেখানে পোকা ধরেছে, গেলাম হারান ঘোষের কাছে। বিত্তান্ত শুনে হারান ঘোষ বললো, তিনজন সুদখোরের নাম লিখে লোহার মানুলিতে পুরে দিচ্ছি- গরুর গলায় ঝুলিয়ে দিবা, দেখবা রামরাম করে পোকাগুলো ভস্ম হয়ে গেছে। এই তিনজন সুদখোরের মধ্যি এই আপদটার নাম হারান ঘোষ এক নম্বরে লিখেছিল। আজ দেখছি হারামির বাচ্চাটা আমাদের সামনেই হাজির। ব্যাটার চেহারাটা কেমন শুয়োরের মতই হয়ে উঠেছে। এর আগে এই গর্দভটাকে কখনো স্বচোখে দেখিনি। ওর নাম শুনে আমার গরুর শিং থেকে বাপ বাপ করে পোকা নেমে গিয়েছিল। কী সাংঘাতিক ব্যাপার!
আজু মোড়ল ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। নানারকম দুশ্চিন্তা মাথার ভেতর থিকথিক করছে। পূর্ণ দফাদার মাথা চুলকাতে লাগলো। সেও একটা কি করা যায়— এই চিন্তা করতে লাগলো। অবশেষে বললো, তুমি যে মিলাদ পড়ানোর কথা বললে, তা কি মুছুল্লিদের বলেছ?
- না, এখনো অবশ্য জানানো হয়নি। ভেবেছিলাম দুপুরের পর মসজিদে গিয়ে ইমামকে জানিয়ে আসব। । - থাক, আজ আর মিলাদ দেওয়ার দরকার নেই। এই পাপটাকে ওর ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে এসো। পূর্ণ দফাদার পরামর্শ দিলো।
গামছাটা কাঁধ থেকে নামিয়ে মুখে জমে থাকা ধুলোবালি মুছতে মুছতে প্রাচীরের ধারের কাছে পড়ে থাকা গরুর গাড়িটির দিকে এগিয়ে গেল। গাড়িটা টেনে এনে আমগাছের গোড়ায় রাখলো। তখনও সাইকেলটা ঘিরে ছেলে-মেয়েরা হইচই করছে। কয়েকজন সাইকেলের পাশে দাঁড়িয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছে। একজন বললো, বাবার কালেতো এসব জিনিস কখনো দেখিনি। কালে কালে আরও কত আজব চিজ দেখব।
আরেকজন বললো, কলিকাল গো কলিকাল। জেবনটা সার্থক হয়ে গেল।
আজু মোড়ল সাইকেলটা টেনে এনে গরুর গাড়িতে তুললো। গাড়ির মাঝখানে একটা বিছানা পেতে বসার জায়গা করা হয়েছে। পূর্ণ দফাদার আর নরহরি দহলিজ ঘর থেকে বাবু মশায়কে নামিয়ে এনে গাড়ির উপর বসিয়ে দিলো। দু'টো দামড়া গরুর কাঁধে জোয়াল তুলে দিয়ে আজু মোড়ল বাবু মশায়কে নিয়ে খেদাপাড়া বসন্তপুরের পথে রওনা হলো।
চলবে....
•••
আগের পর্বগুলো পড়ুন -