দাউদ হোসেন। জন্ম কৃষক পরিবারে, ১৯৪৪ খ্রীস্টাব্দের ২রা মার্চে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বায়সা গ্রামে। পিতা নিছার আলী, মাতা আছিয়া খাতুন। উভয়েই প্রয়াত যথাক্রমে ১৯৭০ ও ১৯৮৩তে। জীবিত এক বোন এক ভাই। গ্রামীণ পাঠশালায় হাতেখড়ি হলেও বাল্য ও কৈশোর কেটেছে তার শার্শা উপজেলার নাভারণ রেলবাজারে। এখানকার বুরুজবাগান প্রাইমারী ও হাইস্কুল থেকে তিনি ১৯৫০-এ ম্যাট্রিকুলেশন, যশোরের মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে ১৯৬২তে আইএসসি পাশ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা (অনার্স) বিভাগে। কোর্সের মাঝামাঝি রাজনৈতিক প্রয়োজনে চলে যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অর্জন করেন পদার্থবিদ্যায় অনার্স ডিগ্রী ১৯৬৫তে। কলেজ জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ১৯৬৫তে পাকিস্তানের নাগপাশ থেকে স্বাধীনতালাভের লক্ষ্যে তিনি সমমনাদের নিয়ে গঠন করেন গুপ্ত সংগঠন 'পূর্ববাংলা জাতীয় মুক্তি সংস্থা'। অল্পকাল পরেই গ্রেপ্তার হন এ সংস্থার বেশকিছু নেতা-কর্মী। গ্রেপ্তার এড়িয়ে দাউদ হোসেন চলে যান গুপ্ত রাজনৈতিক জীবনে, যা ব্যাহত করে তাঁর ছাত্র জীবনকে। পরে ১৯৬৭তে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রী।
১৯৬৬ তে জাতীয় মুক্তিসংস্থার এক প্রতিনিধিদল নিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের শর্তে ঐতিহাসিক ৬ দফার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ ৬০-এর দশকের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তিনি সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে সমাজবিপ্লবের পথে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৬৮ তে তিনি যোগ দেন শ্রমিক-কৃষক কর্মীসংঘে এবং লিপ্ত থাকেন কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কোলকাতায় বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গড়ে তুলতে তিনি শ্রমিক-কৃষক কর্মীসংঘের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
স্বাধীনতার পর শ্রমিক-কৃষক কর্মীসংঘ বাংলাদেশ কমিউনিস্ট কর্মীসংঘ নামে আত্মপ্রকাশ করলে সংঘের প্রয়োজনে তিনি নিজ গ্রামে বসবাস শুরু করেন এবং পেশা হিসেবে অবলম্বন করেন কৃষিকাজকে। যাতে তিনি নিয়োজিত থাকেন দীর্ঘ চৌদ্দটি বছর। এসময়কালে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত করেন একটি হাইস্কুল। এছাড়াও অত্র এলাকায় অনেকগুলি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ও পরিচালনায় তিনি পালন করেন মুখ্য ভূমিকা। ১৯৭৪-এ তিনি বিয়ে করেন তাহমিনা আখতারকে। তাদের এক পুত্র ও দুই কন্যা। ১৯৭৫-এর জানুয়ারীতে ষড়যন্ত্রমূলক এক মিথ্যা মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হন কর্মীসংঘ ও কৃষক সমিতির কয়েক ডজন নেতা-কর্মীসহ। আদালতের বিচারে তারা সবাই নির্দোষ প্রমাণিত হন ১৯৭৭-এ।
১৯৬০-এর দশকে বাংলাদেশের বাম ও কমিউনিস্ট আন্দোলন যখন মস্কো ও পিকিং লাইনে বিভাজিত হয় তখন তিনি ছিলেন এই বিভক্তির ঘোরতর বিপক্ষে। এই বিভক্তির বিলোপবাদী ও হঠবিপ্লবীপনার পাতিবুর্জোয়া চারিত্র উন্মোচনে তিনি সূচনা করেন মৌলিক এক মতাদর্শিক সংগ্রাম। এ প্রক্রিয়ায় মহামতি লেনিনের যেসব অর্থশাস্ত্রীয় গ্রন্থ ইতোপূর্বে মস্কো, কোলকাতা বা এদেশে আদৌ বাংলাভাষায় অনূদিত হয়নি তিনি সেগুলি অনুবাদ করেন যার মধ্যে রয়েছে On the so-called Market Question, The Economic Contents of Narcotism, A Characterization of Economic Romanticism, The Development of Capitalism in Russia। 'রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ' অনুবাদকর্মটি তাঁর অসামান্য মেধা, অধ্যবসায় ও আদর্শিক অঙ্গীকারের এক অনন্য স্বাক্ষর। ডি ব্রাউনের Bury My Heart at Wounded Knee গ্রন্থের অনুবাদ তাঁর সাফল্যের আর একটি স্মারক। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ মার্ক্সবাদের বঙ্গীয় স্বরূপ, বাংলাদেশের উৎপাদন ব্যবস্থা ইত্যাদি। ২০০৩-এ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ফজলুল কাদের কাদেরীর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সুবিখ্যাত গ্রন্থ Bangladesh Genocide and World Press-এর বঙ্গানুবাদ।
রাজনীতির পাশাপাশি তাঁর রয়েছে দীর্ঘ সাংবাদিকতার জীবন। ১৯৮০তে তিনি যশোর থেকে প্রকাশ করেন সাপ্তাহিক শনিবার পত্রিকা। ঢাকার সাপ্তাহিক রোববার-এর সঙ্গে বছর দশেক জড়িত থেকে তিনি এর সিনিয়র সহ-সম্পাদকও ছিলেন বেশ কয়েক বছর। এ ছাড়াও তিনি বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত মাসিক 'আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বুলেটিন'-এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত। ১৯৮৫ থেকে তিনি সপরিবারে ঢাকায় আছেন।