![]() |
নীলরতন ধর |
১৮৯২ সালের আজকের এই দিনে (২ জানুয়ারি) মনিরামপুর উপজেলার হরিহর নগর ইউনিয়নের যোলখাদা গ্রামে যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছিল, কে জানতো পরবর্তীকালে সেই শিশুটি ভারতীয় উপমহাদেশের ভৌত রসায়নের প্রথম পথিকৃৎ হিসাবে গণ্য হবেন?
যশোর শহরের জেলা স্কুল গেট কিংবা সার্কিট হাউজ মোড় থেকে শেখ রাসেল চত্বরের দিকে সে সড়কটি চলে গেছে সে সড়কটির নাম নীলরতনধর রোড। কয়েকবছর আগে কলেজে পড়াকালীন এ পথে ছিল আমার নিত্য যাতায়াত। রাস্তার পাশের প্রতিষ্ঠানগুলো সাইনবোর্ড পড়া আমার পুরানো অভ্যাস। সে অভ্যাসবশতই কোনো এক সাইনবোর্ডে পড়েছিলাম নীলরতন ধরের নাম। মনে প্রশ্ন জেগেছিল, কে এই নীলরতন ধর? যশোর শহরের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সকল সড়ক ঐতিহাসিক ও বিখ্যাত মানুষের নামে। সেই হিসাবে নীলরতন ধর নিশ্চয়ই বিখ্যাত কেউই হবেন। মনে জাগা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানতে পারি যশোরের এই যশস্বী ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে। যার অমর কীর্তির গল্প জানাব আজ।
নীলরতন ধর ছিলেন একজন বাঙালি রয়াসন বিজ্ঞানী। তাকে বলা হয় ভারতে ভৌত রসায়ন গবেষণার প্রবর্তক। সয়েল কেমিস্ট্রিতে তার অবদান সারা বিশ্বে স্বীকৃত। পিতা প্রসন্নকুমার ধর ছিলেন আইনজীবী এবং মাতা নিরোদমোহিনী দেবী ছিলেন যশোরের ফতেপুর জমিদার কুঞ্জবিহারী ঘোষের কন্যা। প্রসন্নকুমারের ছয় পুত্র ও তিন কন্যার মধ্যে নীলরতন ছিলেন তৃতীয়।
অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। পাঁচ বছর বয়সে যশোর সরকারি জেলা স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ফার্স্ট ডিভিশনে বৃত্তি নিয়ে এনট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ভর্তি হন কোলকাতার রিপন কলেজে। এম.এসসিতে কলা ও বিজ্ঞান বিভাগ মিলিয়ে সর্বোচ্চ রেকর্ড নম্বর পেয়ে কুড়িটি স্বর্ণ পদক, গ্রিফিথ পুরস্কার ও এশিয়াটিক সোসাইটি প্রদত্ত ‘গ্রিফিথ মেমোরিয়াল’ পুরস্কার লাভ করেন। ঘটনাটি ১৯১৩ সালের। সেবছর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে কেমিস্ট্রি নিয়ে প্রথম বিভাগে প্রথম হন।
এম.এসসি পড়ার সময়ই আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র ও আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বসুর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয় তার। ছাত্রাবস্থাতেই নীলরতন ১৬টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। যার মধ্যে চারটি গবেষণাপত্র প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে যৌথ ভাবে।
![]() |
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও নীলরতন ধর |
লন্ডন থেকে ১৯১৯ সালে ফিরে তিনি ‘ইন্ডিয়ান এডুকেশনাল সার্ভিস’-এর অধীন ইলাহাবাদের মুরি সেন্ট্রাল কলেজে রসায়নের অধ্যাপনার পদ নেন। পরবর্তীতে এলাহাবাদে ১৯৩৫ সালে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সয়েল সায়েন্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। তার একক প্রচেষ্টায় এবং উপার্জিত অর্থে এই গবেষণাগার তৈরি হয়েছিল। যা ভারতের প্রথম সয়েল কেমিস্ট্রির গবেষণাগার হিসাবে পরিচিত।
বিজ্ঞানী নীলরতন ধরকে ভারতের প্রথম ফলিত রসায়নের প্রবর্তন উল্লেখ করে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তার ‘আত্মচরিত’ গ্রন্থে বলেছেন— ‘১৯১০ সালে ‘ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি’ বৈজ্ঞানিক জগতে স্থায়ী আসন লাভ করিল। কিন্তু ১৯০০ সাল পর্য্যন্ত ইংলন্ডেও এই বিজ্ঞানের জন্য কোন স্বতন্ত্র অধ্যাপক ছিল না। ভারতে এই বিজ্ঞানের অনুশীলন ও অধ্যাপনার প্রবর্ত্তক হিসাবে নীলরতন ধরই গৌরবের অধিকারী। তিনি কেবল নিজেই এই বিজ্ঞানের গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন নাই, জে. সি. ঘোষ, জে. এন. মুখার্জ্জী এবং আরো কয়েকজনকে তিনি ইহার জন্য অনুপ্রাণিত করেন।”
দীর্ঘ ৭০ বছরের কর্মজীবনে তিনি দেশ-বিদেশের অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য - লন্ডন কেমিক্যাল সোসাইটির ফেলো, ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের রসায়ন বিভাগের সভাপতি, ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও পরে সভাপতি, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স-এর সভাপতি ইত্যাদি।
ব্যক্তি জীবনে মিতব্যয়ী এই বিজ্ঞানী সারা ভারতে বিজ্ঞান প্রসারের জন্য প্রচুর অর্থ দান করেছেন। তার সারা জীবনের উপার্জিত অর্থ এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সয়েল সায়েন্স, চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানে দান করে গিয়েছেন। এলাহাবাদে ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্স এর জন্য তিনি ২০ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছিলেন। তাঁকে সম্মানিক ডি এসসি উপাধি প্রদান করে কলিকাতা, বিশ্বভারতী, বেনারস, গোরক্ষপুর, এলাহাবাদ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ভারত সরকার তাঁকে 'পদ্মশ্রী' খেতাব দিতে চাইলে তিনি তা বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখান করেন।
নীলরতন তাঁর গবেষণাকে শুধুমাত্র ল্যাবরেটরিতে সীমাবদ্ধ রাখেননি। সাধারণ মানুষের যেকোন প্রয়োজনে ছুটে গিয়েছেন তাঁদের মধ্যে। এলাহাবাদে কৃষকদের অনুর্বর জমিতে উর্বারতা ফিরিয়ে আনতে যুগান্তকারী কাজ করেছিলেন তিনি।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কর্মব্যস্ত জীবন যাপন করে গিয়েছেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে প্রায় ১৫০ জন গবেষক ডি এসসি ও ডি ফিল ডিগ্রি পেয়েছিলেন। সারা জীবনে তিনি প্রায় ৬০০টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন।
তার অধিকাংশ বই এবং জার্নাল ইংরেজিতে প্রকাশিত। তবে বাংলা বইও আছে। তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো - আমাদের খাদ্য, জমির উর্বরতা বৃদ্ধির উপায়, নিউ কনসেপশন ইন বায়ো-কেমিস্ট্রি, ইনফ্লুয়েন্স অফ লাইট ইন সাম বায়ো-কেমিক্যাল প্রসেসেস ইত্যাদি।
নোবেল কমিটিতে নীলরতন ধর
নীলরতন ধর নোবেল পুরস্কার না পেলেও দু’বার তাঁর নাম নোবেল কমিটিতে সুপারিশ করা হয়েছিল। এছাড়া ১৯৩৮, ১৯৪৭ ও ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার কমিটিতে রসায়ন বিভাগে বিচারক ছিলেন তিনি।
যশোরের মনিরামপুরে জন্ম গ্রহণ করা উপমহাদেশের প্রখ্যাত এই ব্যক্তিত্ব ১৯৮৬ সালের ৫ ডিসেম্বর ৯৪ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। যশোরবাসী আজ তার নাম ভুলতে বসেছে। যশোর শহরে তার নামে সড়কটি অধুনা ভোলা টাংক রোড হিসাবে পরিচিতি লাভ করছে। যা অত্যন্ত লজ্জার ও বেদনার।