কেমন ছিল ঝিকরগাছা, মুক্তির প্রদোষ আভায়! বিগত হাজার হাজার বছর পিছনে ফেলে সেই প্রথম সকালের উন্মেষ হয়েছিল মৌনতামাখা কপোতাক্ষীর বহমান শ্যামল বুকে এক চঞ্চল ভ্রমর গুঞ্জরণে; মুক্তি, আহা মুক্তির স্বাদ, আহা পরম আরাধ্য স্বাধীনতা!
ঝিকরগাছা বি.এম. হাইস্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ঠিকমত ক্লাস হয়না। তার আগের আমার বিদ্যায়তন ঝিকরগাছা বাজার প্রাইমারি স্কুল। বিভিন্ন আন্দোলন, তথা ছাত্রদের ডাকা ধর্মঘটের কবলে ক্লাস খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলে। কোনক্রমে ফ্রেব্রুয়ারি মাসে কিছু ক্লাস হলেও মার্চ থেকে স্কুলে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। দেশের রাজনীতির অঙ্গনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কী-বা বুঝি! খেটেখাওয়া বাপের আড়তদারীতে সহযোগিতা করি, আর বাড়ির কাছের কপোতাক্ষের ঘাটগুলোতে শুকিয়ে যাওয়া নদীর বুকে রঙিন পুঁটি, ধবল চ্যালা-খয়রা আর ধূসর বেলে মাছ খেপলাজালে ধরি। আর কাটাখালের সমবয়সী বন্ধুদের সাথে উচ্ছন্নে যাওয়ার অবসর সময় কাটায়। তবে কলোনী পাড়ার হাতেমের চায়ের দোকানে বয়ষ্কদের চায়ের আড্ডায় ধূমায়িত চায়ের কাপে দেশের উত্তাপের আঁচ পাওয়া যায়। সবার মাঝে আসন্ন দূর্যোগে কী হবে, বা কোন রক্তপাত ও সশস্ত্র মোকাবিলার প্রয়োজন হবে, এমন উদ্বেগ মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বুঝতে পারা যায়নি।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর একটু সচেতন যারা, নিয়মিত খবরের কাগজ পড়তেন ও রেডিওতে বিবিসি শুনতেন, তারা নড়েচড়ে বসলেন। বড় দু'বোন বিবাহিত ছিলেন। তৃতীয় বোন, আরো দু'ভাইবোন সহ আমাকে নদীপথে মার্চের মাঝে অন্যান্য ভারতগামী পরিবারের সাথে আব্বা বয়রার পথে নৌকাতে তুলে দিলেন। উদ্দেশ্য বয়রা হয়ে বনগাঁয়ের পাইকপাড়ার আত্মীয় বাড়ি। সেসময় ভারতীয় বর্ডার খুলে দেয়া হয়েছে, তবে শরণার্থীর ঢল নামেনি, একেবারে প্রাথমিক পর্যায়। সেখানে প্রায় ৪ মাস অতিবাহিত করে জুলাই মাসের প্রথমদিকে ঝিকরগাছায় ফিরে এসে হানাদার পাকিস্তানি অবরুদ্ধ বাজারে বড় দুলাভাই মোঃ রওশন আলী (হাজিরালী) এর সাথে দোকানদারী করতে থাকি। মুদিপট্টির সোবহান মিয়ার দোকানের বিপরীতে মেজমামা মোঃ মতিয়ার রহমান বিশ্বাসের মুদি দোকানের বারান্দায় কাঠের ছোট দোকানে আমরা তিনজন বসতাম, দুলাভাই, মোস্তফা মামা ও আমি। সে যাই হোক, অনেক স্মৃতি ভিড় করছে, কিন্তু আমাকে নিবদ্ধ থাকতে হচ্ছে ঝিকরগাছার মুক্ত হওয়ার স্মৃতিতে।
মনে পড়ে, নভেম্বর মাসের মাঝ থেকে যৌথ বাহিনী (মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী) পশ্চিম সীমান্তে (বয়রা, মুক্তোরপুর, কাবিলপুর, গরিবপুর) প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু করে (ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধাভাজন ইন্দিরা গান্ধীর ১৫ নভেম্বর রেডিও ভাষণ পাশের বাসার টুনু মামার রেডিওতে শুনেছিলাম)। পশ্চিম দিকের যুদ্ধ ক্রমান্বয়ে উত্তর দিকে যশোর সেনানিবাস বরাবর এগুতে থাকে। একদিন রাত ন'টার দিকে শম্ভুদের বাঁশবাগানের ওপর পশ্চিম-উত্তরদিকে দূরের বর্ণিল আলোর ঝিলিক (ট্রেসার বুলেটের আলো) ও গুড়ুম গুড়ুম দূরবর্তী যুদ্ধের শব্দ শোনা গেল। সেপ্টম্বর-অক্টোবর মাসের গভীর রাতগুলোতে এক ধরনের শেলিংয়ের শব্দে ঘুমের ঘোর কেটে যেত ছুটিপুরের দিকের সংঘটিত যুদ্ধে। নভেম্বরের মাঝ থেকে যুদ্ধের ক্ষেত্র পরিবর্তন হয়ে যায়। রাতে আমাদের বাড়িতে আলো জ্বলে না, কারণ পাশের কালীতলায় (খালপাড়ের তিনরাস্তার মোড়ে) পাকিস্তানি সৈন্যদের চৌকি ও ব্যাংকার এবং রাতে কার্ফু জারী করা। নভেম্বরের শেষের দিকে একদিন পশ্চিম দিক থেকে দু'টি কামানের গোলা আমাদের বাড়ির আকাশের ওপর দিয়ে ঝিকরগাছার কীর্তিপুরে পড়ে। পরদিন সকালে আব্বা আমাদেরকে দক্ষিণ দিকের ৩-৪ মাইল দূরবর্তী কাশেমপুর গ্রামে আমজাদ মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। ভ্যান রিকসা করে আমরা সেখানে যাই। বাড়ির মাটির ঘরের চারদিক চওড়া বারান্দা, নভেম্বরের প্রবল শীতে চারপাশ উন্মুক্ত বারান্দায় থাকা শুরু করলাম। এদিকে মোস্তফা মামাকে নিয়ে পেট চালাতে দোকানদারী চালিয়ে যায়। দুলাভাই মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার অপরাধে নভেম্বরে রাজাকারদের হাতে গ্রেফতার হন, ছাড়া পাওয়ার পর থেকে লাপাত্তা, আর বাজারমুখি হননি।
ডিসেম্বরের প্রথমেই ঝিকরগাছা বাজারের আকাশে ভারতীয় যুদ্ধবিমান ন্যাট চক্রর দিতে থাকে, তবে গোলাবর্ষণ করে না, এক বা দু'চক্কর দিয়েই অন্যকোথাও চলে যায়। রোডব্রীজের গোড়ায় ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাক্স্তিান, যা পরবর্তিতে সোনালী ব্যাংক, তার ছাদে পাকিস্তানি সৈন্যদের এন্টি এয়ারক্রাফ্ট গান বসানো, সেখান থেকে যুদ্ধবিমান বরাবর ক্যাট-ক্যাট শব্দে গুলি ছোড়ে, আর থানায় সতর্কীকরণে সাইরেন বাজানো হয়। দুলাভাইয়ের নির্দেশ ছিল, এয়াররেড হলে দোকান বন্ধ করে রেললাইন পার হয়ে মোবারকপুরের দিকে চলে যেতে হবে। রেল লাইনের ওপাশ নিরাপদ, কোন পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্যাম্প নেই। আমি এরকম পরিস্থিতিতে দু'দিন বাজার থেকে দৌড়ে রেললাইন পার হয়ে ধোপাপাড়ার একতলা ব্লিডিংয়ের নিচে দাঁড়িয়েছিলাম। আর যুদ্ধবিমানের উড়াউড়ি লক্ষ করতাম, দু'টো আবার তিনটে বিমান রেড করতো, একটা বেশ উপরে থাকতো, অন্যটা বেশ নিচুতে বোমা ফেলার মহড়া দিত, কিন্তু কোন গোলাবর্ষণ করতো না। সেই বয়সে আমার মাঝে কোন মৃত্যু ভয় ছিলনা। এ সময় বাজারে কাজ করা মারাত্বক ঝুঁকিতে পড়লে আব্বা দোকান খুলতে নিষেধ করেন। তারপর আর বাজারে যাওয়া হয়নি, কাশেমপুরে সমবয়সীদের (সম্ভবতঃ সিরাজ ভাইও থাকতেন) সাথে সময় কাটাতে থাকি, মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ায়, কাশেমপুর ও মোবারকপুর সন্নিহিত গ্রামের মাঝে বিস্তীর্ণ মাঠের উপর দিয়ে খুব নিচুতে উড়ে ন্যাট যুদ্ধবিমান যশোরের আকাশে উঠে যায় এবং ক্যান্টনমেন্টে বোমা বর্ষণ করে অন্যপথে ভারতে ফিরে যায়।
এরকম সন্ত্রস্ত দিনযাপনের একরাতে আমরা বারান্দায় গভীর নিদ্রামগ্ন, তখন ঘড়ি দেখার সুযোগ ছিল না, কাঁপুনি ও উজ্জ্বল আলোর ঝলকানিতে বারান্দায় আমাদের সবার ঘুম ভেঙে যায়। এরকম কয়েকবার হয়। আমজাদ মামা, আব্বা উঠোনে নেমে আসেন, ঝিকরগাছার দিক থেকে ক্ষীণ শব্দের গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যায়। তেমনি পাখিদের কিচিরমিচির, আর ভাল ঘুম হয়নি। খুব ভোরে কাউকে কিছু না বলে হলুদ সোয়েটার গায়ে চাপিয়ে ঝিকরগাছা বাজারের পথে পা বাড়ালাম। মোবারকপুরের প্রারম্ভে লোকজন বেরিয়ে পড়েছে, প্রথম শুনলাম, 'খানেরা ভেগেচে'। শীতে রবারের পারুমা জুতো আরো ঠাণ্ডা, সব উপেক্ষা করে জোরে ছুটছি, ঘোর কুয়াশা মেখে রেলব্রীজের দু'টি বিধ্বস্ত স্প্যান নদীর বুক ছুঁয়ে আছে। লোকজন ছুটে আসছে, রোডব্রীজও ভেঙে কয়েক টুকরো, ডিনামাইট দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তারই উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি কাশেমপুরে দেখেছি। আস্তে আস্তে বাজার মানুষে ভরে যাচ্ছে, খণ্ড খণ্ড ও অসংগঠিত জমায়েতে 'জয়বাংলা' শ্লোগান উঠছে। এরমাঝে একজন সাইকেলের হান্ডেলে বসিয়ে কীর্তিপুরের দিক থেকে এক খানসেনাকে ধরে নিয়ে আসে পাকিস্তানি সহযোগিদের বানানো শান্তি কমিটির অফিসের সামনে। সে নাকি বাঙ্কারে ঘুমিয়ে যাওয়াতে অন্যদের সাথে পালাতে পারেনি। উপস্থিত জনতা তাকে আক্রমণ করলে কোনক্রমে সেই অফিসে ঢুকিয়ে রাখা হয়। উপস্থিত নেতারা বলেন, 'আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।' বাজারে কোন রকম লুটপাট হয়নি, ডিনামাইট বিষ্ফোরণে দোকানগুলোর ঝাঁপি বা দরজা খুলে গিয়েছিল, আমাদের দোকান সুরক্ষিত করি। তবে এপ্রিলের প্রথমে ঝিকরগাছা পাকিস্তানিদের হাতে পতন হলে বাজারে ব্যাংকলুটসহ বিভিন্ন স্থাপনায় লুটতরাজ করা হয়েছিল বলে শুনেছিলাম।
রোদওঠার সাথে সাথে বাসস্ট্যান্ড ও আমার প্রাইমারির বন্ধু লোকনাথদের বাড়ির সামনে ভিড় বাড়তে থাকে। এই দুঃসময়েও বাজার কামড়ে পড়ে থাকা মাড়োয়াড়ি চুনিমিয়া ওরফে চুনিলালকে সুন্নতি টুপিছাড়া দেখতে পেলাম। পারবাজারের নদীর পাড়ের বসবাসকারী হিজড়াদের উচ্ছ্বাস উপচে পড়ছিল। আমরা বাসস্ট্যান্ড থেকে ব্রীজের ভাঙা অংশ পর্যন্ত আনন্দ করতে করতে ছুটছিলাম, এমন সময় সকাল সাতটা হবে, বাজারের আকাশে ভারতীয় যুদ্ধবিমান চক্কর দিলো, আমি ব্রীজের পাশের ন্যাশনাল ব্যাংকের বারান্দায় উঠে গেলাম। পারবাজারের গরুহাটে লোকে লোকারণ্য, তারা আনন্দে চিৎকার করছে, জয়বাংলা শ্লোগান দিচ্ছিল। থানার দিক থেকে হঠাৎ একটা যুদ্ধবিমান নোজ নিচু করে গুলিবর্ষণ সেরে নোজ উঁচু করে যে চলে গেল, আর আসলো না। শুনেছিলাম দু'জন নিরীহ মানুষ মারা গেছেন। ঝিকরগাছা যে মুক্ত হয়েছে, সেই খবর তখনও ভারতীয় বাহিনীর হাতে পৌঁছায়নি। যুদ্ধবিমানের গুলিবর্ষণে সাধারণ মুক্তিকামী মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ে, তখনও কোন সংগঠিত মুক্তিবাহিনীর দল বাজারে ঢুকতে পারেনি। আর একটু এদিক-ওদিক ঘুরে বাড়ির কথা মনে পড়লো, বিগত এপ্রিলে আমাদের বাড়ির সাথের গুদামঘর ও বাড়ি লুট হয়েছিল। এবার আর লুট করারা মতো কিছু নেই, আমরা তখনই নিঃস্ব হয়ে গেছি। তারপরও কাটাখাল পানে ছুটলাম, পথে মাগিপাড়ার শেষে (এখনকার আবুবক্কর স্মৃতি পাঠাগারের পিছনে) পাঁচ-সাতজন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রথম দেখতে পেলাম, ছাত্রনেতা রশিদুর রহমান রশিদের নেতৃত্বে একদল যোদ্ধা বাজারে ঢুকছেন। রশিদ ভাইকে চিনতাম, কাঁধে এসএলআর ঝোলানো, আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি বাড়ি পৌঁছে সব ঠিকঠাক পেলাম। কালিতলার পরিত্যক্ত পাকিস্তানি ব্যাঙ্কারের সামনে কথা বলার ক্ষণে হাড়িয়াদাঁড়ার দিক থেকে জলপাই রঙ পোশাকের ভারতীয় সৈন্যদের কলাম সামনে দিয়ে ঝিকরগাছা বাজারে ঢুকতে থাকে, এই পথে দু'টো ট্যাঙ্কও আসে। আমি সৈন্যদের পাশ বরাবর হেঁটে খালের কাছে আসি, খালের ব্রীজ অপ্রশস্ত, তার ওপর দিয়ে ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যান পার হতে পারবে না। স্থানীয়রা পথ দেখালো, রাস্তা বানাতে হাতে হাতে সাহায্য করলো, খালে পানি নেই বললে চলে, এখন যেখানে ঈদগাহ তার ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে নিচে নামিয়ে ওয়াপদার মাঠে উঠে গেল ট্যাঙ্ক ও ভারী যানগুলো। আর এদিকে স্থানীয়দের সহযোগিতায় পারবাজারের গরুহাটের দুই ব্রীজের মাঝ বরাবর ভারতীয় সৈন্যরা বড় বড় বোট ভাসিয়ে ভাসমান ব্রীজ তৈরি করলো। বেলা দশটা নাগাদ ভাসমান ব্রীজ দিয়ে ভারতীয় বিপুল সৈন্যবাহিনী যানবাহনসহ বাজারে ঢুকে যশোরমুখি হতে থাকলো। আমি তখন বাসস্টান্ডের কাছে রিকশা স্টান্ডে দাঁড়িয়ে, জনতা জয়বাংলা শ্লোগানে তাদেরকে স্বাগত জানালো। কেউ ডাবের কাঁধি এনেছিলেন, ডাব কেটে সৈন্যদের হাতে ধরিয়ে দিলেন, অনেকে তাদের সাথে মুক্তির আনন্দে কোলাকুলি করলেন।
ঝিকরগাছার ৬ ডিসেম্বর মুক্ত হওয়ার প্রথম প্রহরের আনন্দময় স্মৃতি আমৃত্যু বয়ে বেড়াব।
লেখক : মোহাম্মদ শামছুজ্জামানকথাশিল্পী, কবি ও প্রবন্ধকার এবং প্রাক্তন মহাপরিচালক, বাংলাদেশ রেলওয়ে।