সিডনি শ্যানবার্গের স্মৃতিতে ঝিকরগাছা

Bengalis Dance and Shout At Liberation of Jessore 'মুক্ত যশোরে বাঙালিদের নাচ ও শ্লোগান'। এই শিরোনামে ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায়। রিপোর্টটি লিখেছিলেন বিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গ। রিপোর্টটির বড় অংশ জুড়ে ছিল দেশের প্রথম শত্রুমুক্ত জনপদ ঝিকরগাছা'র আবেগপূর্ণ মূহুর্তের বর্ণনা। পরবর্তীতে শ্যানবার্গ তার লেখা 'বিয়ন্ড দ্য কিলিং ফিল্ড' বইটিতেও ঝিকরগাছায় সংবাদ সংগ্রহের স্মৃতি উল্লেখ করছিলেন। 'মুক্তির উচ্ছ্বাস : ঝিকরগাছা দিবস ২০২২' উপলক্ষ্যে লেখাটির অনুবাদ প্রকাশ করা হলো। 

আরেকটু যা বলা প্রয়োজন তা হলো, সিডনি শ্যানবার্গ সেই সব বিদেশি সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম যারা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জুড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার তথ্য নিষ্ঠার সাথে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন। এছাড়া সিডনি শ্যানবার্গই ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের অকৃত্রিম এই বন্ধু ২০১৬ সালের ৯ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।


ঝিকগাছায় আনন্দের মিলন মেলা
ভারতীয় সীমান্ত থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ২৩ মাইল ভিতরে যশোর রোডে একটি বড় সেতু দক্ষতার সাথে ভেঙে ফেলা হয়েছে। ইস্পাত ও কংক্রিটের তৈরি সেতুটির ছয়টি স্প্যানের পাঁচটিই কপোতাক্ষ নদীতে পড়ে আছে, যেমন ২০০ গজ দূরে পড়ে আছে পাশের রেলসেতুটিও। দুই রাত আগে যশোর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তানিরা ব্রীজ দুটি ধ্বংস করে দিয়েছ। 

যশোর থেকে নয় মাইল দূরে ঝিকরগাছা শহরের স্থানটিতে আজকের দৃশ্যটি দেখে মনে হচ্ছে- সারিসারি মানুষ বাকেট ব্রিগেড তৈরি করে কাজ করছে পিরামিডের বিল্ডিংয়ের মধ্যে।


ধ্বংস হওয়া ব্রিজের নীচে কর্দমাক্ত নদীর তীরে, দীর্ঘ সারিবদ্ধ শত শত বাঙালি নতুন পন্টুন সেতু তৈরি জন্য কাঠের তক্তা এগিয়ে দিচ্ছে।  নির্ভুলভাবে যন্ত্রের মতো কাজ করছে তারা। একই সময়ে সেনাবাহিনীর প্রকৌশলীদের তামাটে সৈন্যরা একটি কম্প্রেসার দিয়ে বিশাল পন্টুনগুলিকে ফুলিয়ে, তারপর হাঁটু-গভীর জলে নেমে একের পর এক পাশাপাশি ভাসিয়ে তার ওপর অ্যালুমিনিয়ামের প্যানগুলি পাতিয়ে দিচ্ছে। সেতুর কাজ শেষ হতে সময় লাগলো চার ঘণ্টা।


সবাই অস্বাভাবিকভাবে খুশি দেখাচ্ছিল—ভারতীয় সৈন্য, বাঙালি শ্রমিক এমনকি ফুটপাতের তত্বাবধানকারীরাও।

ঝিকরগাছা শহরে বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়দের মধ্যে আনন্দের পুনর্মিলন চলছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন দিকে যারা পালিয়ে গিয়েছিল এখন ধীরে ধীরে তারা ফিরে আসছে। কেউ কেউ গিয়েছিলেন ভারতের শরণার্থী শিবিরে আর কেউ কেউ লুকিয়ে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ গ্রামে।

এক পুরানো বন্ধু
এই সংবাদদাতার নিজের সাথেও একটি পুনর্মিলনের ঘটনা ঘটলো। পুরানো সেতুর একটি অক্ষত স্প্যানে দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে একজন জিজ্ঞেস করলো, "তুমি আমাকে চিনতে পারছো?"। আমি চিনতে পেরেছিলামও। তিনি ছিলেন লে. আখতার উজ্জামান, মুক্তিবাহিনী'র একটি কোম্পানির ২৫ বছর বয়সী কমান্ডার - একজন বাঙালি বিদ্রোহী। 

লেফটেন্যান্ট আখতার এক মাস আগে যশোরের দক্ষিণাঞ্চলে গেরিলাদের দখলে থাকা একটি শরণার্থী শিবিরে হাজির হন। তিনি তখন বলেছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়ী হতে মুক্তিবাহিনীর অন্তত দুই বছর লাগবে। আজ তিনি বললেন, "এটা হতো যদি আমরা একাই যুদ্ধ করতাম। এখন তো আমাদের শক্তিশালী সাহায্য আছে।" তিনি হঠাৎ বললেন, "এটি আমার জন্য একটি ঐতিহাসিক সেতু। আমি এখানে চাঁদের আলোতে জলে ঘুরে বেড়াতে আসতাম আমার বান্ধবীর সাথে।" স্মৃতির কথা ভেবে হাসলেন।

বিদেশি সংবাদকর্মীদের বহনকারী জীপটি ঝিকরগাছা থেকে যশোর যাওয়ার রাস্তায় উঠল। রাস্তার ধারে গ্রামবাসী চিৎকার করতে থাকলো “জয় বাংলা!" এবং বিদেশীদের হাত স্পর্শ করার করার জন্য এগিয়ে আসতে থাকলো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

ট্যাগ সমূহ

ঝিকরগাছার ইতিহাস, ঝিকরগাছা উপজেলার ইউনিয়ন, ঝিকরগাছা খবর, গদখালি ঝিকরগাছা, ঝিকরগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান, ঝিকরগাছা পোস্ট কোড, ঝিকরগাছা এমপি, ঝিকরগাছা আবহাওয়া, ঝিকরগাছা উপজেলা ম্যাপ, ঝিকগাছার ঐতিহ্য, পানিসারা, ঝিকরগাছা পৌরসভা, ঝিকরগাছা দর্শনীয় স্থান, ঝিকরগাছা বাজার।