২১ নভেম্বর ১৯৭১। প্রচণ্ড শীত পড়েছে। ঘন কুয়াশায় মোড়া চারিদিক। ২০ নভেম্বর ছিল পবিত্র ঈদ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রথম ঈদ। যা অধিকাংশ মানুষের কেটেছে শরণার্থী শিবিরে। যারা দেশে ছিল তাদের কেটেছে চরম উৎকণ্ঠায়। পবিত্র এদিনেও পাক হানাদার বাহিনী বিভিন্ন স্থানে বিমান হামলা চালিয়েছে সাধারণ মানুষের উপরে। গ্রাম থেকে গ্রাম আগুন জ্বলছে। আগুন জ্বলছে দৃঢ়প্রত্যয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের মনে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নভেম্বরে মাসের দিকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কা ক্রমশ বাড়তে থাকলে ভারতীয় সীমান্তে প্রতিরক্ষা বাড়ায় পাকবাহিনী। ঝিকরগাছা অক্ষে ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট, সাতক্ষীরা অক্ষে ১৫ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট এবং চৌগাছা-যশোর অক্ষে ৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট দ্বারা প্রতিরক্ষা লাইন তৈরি করে রাখা হয়। এর বাইরে যশোর সেনানিবাসে রিজার্ভ হিসেবে রাখা হয় ২১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে। কিন্তু পাকবাহিনী তাদের প্রতিরক্ষা লাইনে বয়রা সীমান্তে কোনো সেনা রাখেনি। তার বড় কারণ তাদের ধারণা ছিল নদী-খাল-বিল বেষ্টিত, কাদাময়, জনাকীর্ণ ও জঙলা এ অঞ্চল দিয়ে মুক্তিবাহিনীর কিছু গেরিলা আক্রমণ ছাড়া বড় কোনো আক্রমণ সাজানো সম্ভব না। মূলত এটিই ছিল তাদের মস্ত ভুল। আর এ ভুলের সুযোগ নেয় মুক্তির চেতনার উদ্দীপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী।
বয়রা সাব সেক্টরের ক্যাপ্টেন ছিলেন নাজমুল হুদা। তিনি বেনাপোলে গিয়ে সেক্টরে গিয়ে কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুরকে বিষয়টি জানান। মেজর মঞ্জুর ভারতীয় বাহিনীর নিকট সাহায্য চান। এসুযোগ না হারাতে দ্রতই বয়রাতে মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দেয় ভারতীয় মিত্রবাহিনী। দুই বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত হয় যৌথবাহিনি।২১ নভেম্বর ভোরে পাকবাহিনী প্রথম জানতে পারে মিত্রবাহিনীর অবস্থানের কথা। ততক্ষণে বয়রা সীমান্ত পেরিয়ে মিত্রবাহিনী ৩-৪ কিলোমিটার ভেতরে গরীবপুরে ঢুকে পড়েছে। সীমান্তের ওপাড়েতে বয়রা এপাড়েতে গরীবপুর। দুই গ্রামের মাঝে সীমানা এঁকে দিয়েছে কপোতাক্ষ। পাকবাহিনীর অগোচরে মিত্রবাহিনী কপোতাক্ষ নদের উপর একটি অস্থায়ী সামরিক সেতু নির্মাণ করে ১৭টি ট্যাংক বহর পার করে ফেলেছে। ২১ নভেম্বর ভোরে পাকবাহিনী দুটি রেজিমেন্ট প্রথম প্রতিরক্ষমূলক আক্রমণ চালায়। ঘন কুয়াশার কারণে মিত্রবাহিনীর অবস্থান আঁচ করতে পারছিল না তারা। মুখোমুখি এ যুদ্ধে আক্রমণ চলছিল উভয় পক্ষ থেকেই। তবে ভারতীয় বাহিনী আকষ্মিকভাবে ট্যাংক হামলা চালালে অল্প সময়ের ভেতরই পাকবাহিনীর ঘাটি ধ্বংস হয়ে যায়। দূর্গম এ অঞ্চলে ট্যাংকের প্রবেশ দেখে বোকা বনে যায় পাকবাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার হায়াত খান। পিটি ৭৬ মডেলের রাশান এই ট্যাংক মূলত উভচর। জলে এবং স্থলে সমানে দাপিয়ে বেড়ায়।
পরিস্থিতি বেগতিক বুঝতে পেরে হায়াত খান দ্রুত ১৪টি অত্যাধুনিক এম-২৪ লাইট মার্কিন শ্যাফে ট্যাংক নিয়ে প্রতিরক্ষা মূলক আক্রমণ চালায়। তবে মিত্রবাহিনীর ক্রমাগত গোলাবর্ষণে সুবিধা করতে পারেনি তারা। শোচনীয় পরাজয়ের গন্ধ পেয়ে পিছু হটতে থাকে পাকবাহিনী। পিছু হটার সময় গ্রামে গ্রামে গণহত্যা চালাতে থাকে। এদিকে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী ক্রমশ দেশের অভ্যন্তরে ঢুকতে থাকে।২২ নভেম্বরে প্রথম পরিকল্পিত বিমান হামলা চালায় পাকবাহিনী। এর জবাবে মিত্রবাহিনীও পাল্টা বিমান হালমা শুরু করে। এ বিমানযুদ্ধে পাকবাহিনীর ২টি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়।
২১ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া সম্মুখ সমরের এ যুদ্ধ চলে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত। ৪ দিনের এ যুদ্ধে যৌথবাহিনির ১৯জন শহীদ হন এবং পাকিবাহিনীর শতাধিক নিহত হন। এছাড়া এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ১৪টি এম-২৪ লাইট মার্কিন শ্যাফে ট্যাংক ও ২টি স্যাবর এফ৮৬ যুদ্ধবিমান এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ৫টি পিটি-৭৬ ট্যাংক বিধ্বস্ত হয়।তৎকালীন ঝিকরগাছা উপজেলার গরীবপুরে (বর্তমান চৌগাছা উপজেলা) সংগঠিত এ যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং সফল যুদ্ধ। যা ইতিহাসে নাম করে নিয়েছে 'ব্যটল অব গরীবপুর' নামে। এ যুদ্ধের পর থেকেই পাকবাহিনী বুঝতে পারে তাদের পরাজয় নিশ্চিত। তাই তারা পিছু হটতে থাকে। যশোরের সেনানিবাস থেকে পালাতে থাকে খুলনা ক্যান্টনমেন্টের দিকে।
মিত্রবাহিনী তাদের বহর নিয়ে ক্রমশ যশোরের দিকে এগুতে থাকে। যশোর ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণের সম্ভাবনা থেকে ডিসেম্বরের ৩-৪ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকবাহিনী ঝিকরগাছা অঞ্চল থেকে পালাতে শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য খুলনার শিরোমনির দৌলতপুর ক্যান্টনমেন্ট।
পিছু হটার মূহুর্তে আরেকটি ছক কষে তারা। মিত্রবাহিনীর সুসজ্জিত সামরিক বহর যাতে সহজে খুলনার দিকে এগুতে না পারে সেজন্য বিভিন্ন স্থানে বাঁধার সৃষ্টি করে তারা। পরিকল্পনার মূল অংশ ছিল ঝিকরগাছা বাজারের কপোতাক্ষের উপরে রেল ও সড়ক সেতু ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়া।
পরদিন (৬ ডিসেম্বর) সকালে ঝিকরগাছা এসে পৌঁছান মিত্রবাহিনীর সদস্যরা। ভাঙা ব্রীজটির উপরে উত্তোলন করেন স্বাধীন দেশের মুক্ত পতাকা। ব্রীজটির নামকরণ করেন 'BIJOY BRIDGE'। অর্থাৎ এ ব্রীজটি দেশের প্রথম হানাদার মুক্ত অঞ্চলের সাক্ষী। আন্তর্জাতিক অনেক পত্রিকায় স্থান পায় এ ঘটনা। তারা ঝিকরগাছাকে উল্লেখ করে 'দ্য ফার্স্ট লিবারেটেড ভিলেজ' হিসাবে।
গরীবপুরের বীরত্বকাহিনি নিয়ে সিনেমা
গরীবপুরের যুদ্ধের গল্প নিয়ে বলিউডে নির্মিত হয়েছে সিনেমা 'পিপ্পা''। যা মুক্তি পেয়েছে গত ২ ডিসেম্বর। রাজা কৃষ্ণ মেননের পরিচালনায় সিনেমাটিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন এ আর রাহমান। মূলত মিত্রবাহিনী সদস্য ব্রিগেডিয়ার বলরাম সিংয়ের লেখা ‘দ্য বার্নিং চ্যাফি’ বই অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি। তিনি গরীবপুরের যুদ্ধে মিত্র বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করেন।