মুক্তির প্রথম প্রহরে ঝিকরগাছা


মুক্তির প্রথম প্রহরে ঝিকরগাছা - হোসেনউদ্দীন হোসেন

৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১। প্রচণ্ড শীত পড়ছে। রাতের বেলা ঘুম হয়নি। যুদ্ধের গতি প্রকৃতি কোনো দিকে মোড় নিচ্ছে কিছুই জানতে পারছি না। ভোর বেলা ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি চার দিকে এলোমেলো ভাব। লক্ষ্মীপুর গ্রামেই জনগণের মধ্যে দেখা দিয়েছে একটা শঙ্কা। মনে হচ্ছে যুদ্ধটা যেন ঘাড়ের উপরে এসে পড়েছে। হানাদার বাহিনীর সেপাইরা এদিক ওদিক থেকে হেঁটে এসে লক্ষ্মীপুর এবং লাউজানিতে জড়ো হচ্ছে। চেহারায় একটা মার মার ভাব। এখানে ওখানে গিয়ে রাইফেল তাক করে বসে পড়ছে। আশেপাশের গ্রামের লোক সহায় সম্পত্তি ফেলে ভেগে যাচ্ছে। আমি আমার স্ত্রী ও পরিজন নিয়ে এই গ্রাম থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যে কোনো মুহূর্তেই বিপদ নেমে আসতে পারে। অতএব সময় থাকতেই নিরাপদ স্থানে যাওয়া ভালো। কোলের ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। সঙ্গে আমার অপ্রাপ্ত বয়স্ক শ্যালক শ্যালিকা ও শাশুড়িআম্মা। উদ্দেশ্য কাশিপুর পর্যন্ত যাব। কাশিপুরে আমার স্ত্রীর নানার বাড়ি।

পশ্চিম দিক থেকে অসংখ্য লোক ভেগে আসছে। তাদের চেহারায় একটা ভয়ার্ত ভাব। অনেকেই কাদঁছে। লাউজানি সড়কে উঠতেই দেখলাম, হানাদার বাহিনীর সেপাইরা বিক্ষিপ্তভাবে ট্রেন লাইন ধরে লাউজানির সড়কের দিকে আসছে। যে দিকে লোকজন হেঁটে যাচ্ছে সেই দিকে ওদেরও আগমন। মনে মনে দারুণ শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। একদিকে আনন্দ অনুভব করছি আর একদিকে শঙ্কিত হয়ে উঠছি।

আমি বুঝে ফেলেছি ওরাও এখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে শুরু করেছে। ওদের চলাফেরায় বলে দিচ্ছে, ভেগে যাওয়া সেপাই। জন্তুর মতো ওদের চেহারা। যে কোনো মহূর্তেই রক্তপাত ঘটাতে পারে।

রেল সড়ক সাবধানে পার হয়ে এলাম। সেপাইরাও আমাদের পাশে পাশে হেঁটে চলেছে। ওদেরকে এড়িয়ে আমরা মল্লিকপুর গ্রামের দিকে গেলাম। ওরাও আমাদেরকে এড়িয়ে বাম দিকে হেঁটে যেতে লাগল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম।

পথে যেতে যেতে বুঝলাম, রাজাকাররাও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। গায়ে যে পোশাক ছিল ফেলে দিচ্ছে। শুধু কেবল হাতে আছে রাইফেল। চারণভূমিতে বাঘ ঢুকলে ছাগল গরুর যেমন দশা হয়—ঠিক তেমনি দশা হয়েছে ভেগে যাওয়া সেপাই আর রাজাকারদের।

দুপুরেই আমরা কাশিপুর গ্রামে এসে হাজির হলাম। এই অঞ্চলে বহুদিন আসিনি। মামারা আমাদেরকে সাদরে গ্রহণ করলেন। একটা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। অনেকেই ঝিকরগাছা মোবারকপুর এবং বিভিন্ন গ্রাম থেকে ভয়ে এই গ্রামে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। অধ্যাপক মহাসিন আলী সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি মোবারকপুর থেকে এখানে এসেছেন। মহাসিন ভাই যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। বিকেলে তার সঙ্গে বসে পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ আলোচনা হলো। হানাদার বাহিনী যে চম্পট দিচ্ছে এতে কোনা সন্দেহ নেই। সবকিছু স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তবুও আমরা সচেতন হয়ে কথা বলতে লাগলাম ।

সন্ধ্যার পর সমগ্র অঞ্চল নিঝুম হয়ে এলো। সমস্ত গ্রামগুলো নিষ্প্রদীপ। কোথাও আলো নেই। মাঝেমাঝে কারো কারো ঘরে বিন্দুর মতো আলোর কণা দেখা যাচ্ছে। আবার নিভে যাচ্ছে। শীতের হিমেল বাতাস বয়ে চলেছে। শীতে কুকড়ে যাচ্ছে শরীর। কোথাও কোনো শব্দ নেই। স্তব্ধ নিঝুম।

রাত ১২টায় বিকট শব্দে মাটি কেঁপে উঠল। নিকটে কোথায় যেন একটা প্রলয় কাণ্ড ঘটে গেল। দুড়ুম দাড়াম করে এক নাগাড়ে শব্দ হতে লাগল। গুলি গোলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ভয়ে আতঙ্কে শরীর কাঁপছে। মনে হলো, ঝিকরগাছা বাজারে তুমুল লড়াই শুরু হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিঃশব্দ হয়ে গেল সব। রাতে ঘুম হলো না। বসে বসে কাটালাম। কাশিপুর গ্রামটা কবরের মতো মনে হতে থাকলো। ভোরের আভাস দেখা গেল। ঘরের দরোজা খুলে বেরিয়ে এলাম।

শীতে শরীরটা কাপতে লাগল। এখনো চারদিকে অন্ধকার। গায়ে চাদর জড়িয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে পথে এসে দাড়ালাম। মনটা বিহবল হয়ে উঠেছে। কোথায় যে কি ঘটেছে, জানার জন্যে উৎসুক হয়ে উঠলাম।

রাস্তাটা নির্জন। আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলাম আমি। কোথাও কোনো লোকজন নেই। না আছে সাধারণ মানুষ। না আছে হানাদার বাহিনী। না আছে রাজাকর-আল শাসম। যশোর সড়কে এসে পা রাখলাম। পুরের সূর্য তখন উঠি উঠি করছে। আমি দেখলাম, সিও অফিসের মোড়ে কয়েকটা সামরিক বাহিনীর গাড়ি পড়ে আছে। এই গাড়িগুলো পুড়ে ঝলসে গিয়েছে। রাস্তার পাশেই যে গাছগুলি রয়েছে, সেখানে অসংখ্য বুলেটের গর্ত। এই গাড়িগুলোর মধ্যেই ছিল বারুদ। ওরা পালিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ি গুলোতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে যায়। রাত্রে যে গুলির শব্দ ভেসে আসছিল, তা এই গাড়িতে রাখা আগুনে পোড়া গুলির শব্দ। আরো একটু বাজারের দিকে হেঁটে গেলাম। দুপাশে তাকিয়ে দেখলাম বাড়ি এবং দোকানের দরোজা জানালা খোলা। রাস্তা ফাঁকা। ঘরবাড়ি দোকান ফাঁকা। কারা যেন দরোজা জানালা কপাট আছড়িয়ে ভেঙে রেখে গেছে। নদীর দিকে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। দুটি ব্রিজই এক্সাপোলোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। স্লাভগুলো দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে নদী গহ্বরে। রাত বারোটায় যে বিকট শব্দ শোনা গিয়েছিল, তা এই ব্রিজ ভাঙার শব্দ। এই শব্দে যে ভূমিকম্পন হয়েছিল - সেই কম্পনেই বাড়ি ও দোকান গুলোর দরোজা জানালা ভেঙে গিয়েছে।

কোথাও আমি হানাদার বাহিনীর অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না। গতকাল রাত বারোটা পর্যন্তও ছিল তাদের অস্তিত্ব। আজ তাদের কোনো অস্তিত্বই নেই। হায়, কোথায় গেল সেই বিরাট বিশাল ও ভয়ঙ্কর দাপুটে মানুষ গুলো।

ঝিকরগাছা ব্রীজ jhikargacha bridge
পাকবাহিনীর উড়িয়ে দেয়া সেতু ও উৎসুক জনতা

সূর্য একটু একটু করে উপরে ঠেলে উঠছে। শ্মশানের মতো খাখা করছে বাজারটা। সবুল হকের সঙ্গে দেখা হলো। বাজারে তার মিল রয়েছে। অবস্থা জানার জন্য বাজারে ছুটে এসেছেন। গত এপ্রিল মাসে তার মিল থেকে অনেক কিছু দুর্বৃত্তরা লুটপাট করে নিয়ে গিয়েছিল। এমনকি কারখানার টিনও লুট হয়ে গিয়েছিল। আজও তেমন কিছু হলো কিনা দেখতে এসেছেন। আমরা দুজনে সারা বাজারটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। বেশ কিছু লোকও ছুটে এসেছে। অনেকের উদ্দেশ্য ছিল লুট করা। আমরা হুশিয়ার করে দিলাম, যদি কোথাও কোনো লুটপাট করো—তবে খবর আছে। যার যেখানে যে জিনিসপত্র আছে, সেখানেই থাকবে। হারিয়ে গেলে কৈফিয়ত দিতে হবে। দুপুর হয়ে এলো। আকাশে যুদ্ধ বিমান ঘুরছে। চারদিকে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। কোথায় ঘাপটি মেরে দুশমন আছে কি না, আকাশ থেকে তল্লাশি করছে। আমরা জয় বাংলা বলে জয় ধ্বনি দিতে লাগলাম।

বিমানটা কয়েকবার ঘুরপাক খেয়ে একটা বোমা ফেলল। বিশাল একটা গর্জন করে বোমাটা গো হাটের পাশে মন্দিরের সংলগ্ন একটা ফাঁকা জায়গায় ফাঁটলো। লোকজন ভীত হয়ে পালাতে শুরু করল।

আমি এবং সবুল হক একটা ঘরের বারান্দার কোণে নিয়ে বার বার আকাশে শকুনের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল যুদ্ধ বিমানটা। আবার যদি তারা আরো কয়েকটি বোমা ফেলে, তা হলে সমগ্র বাজারটা ধ্বংস স্তূপে পরিণত হবে। দারুণ একটা উদ্বিগ্নতা অনুভব করতে লাগলাম। যারা বাজারের মধ্যে ঢুকেছিল, তারা পালাতে শুরু করল। আবার ফাঁকা হয়ে উঠল বাজারটা।

আমি এবং সবুল হক দুজনেই একটা ঘরের বারান্দায় বসে রইলাম। বিকেলের শেষ দিকে কয়েকজন ভারতীয় সৈন্য পশ্চিম দিকের কাটাখাল পার হয়ে বাজারের ভিতরে এসে ঢুকলো। আমরা দুজন তাদেরকে অভিনন্দন জানালাম। বললাম, দুশমনরা রাতের বেলা ব্রীজ দুটো ভেঙে দিয়ে পুবের রাস্তা ধরে মনিরামপুরের দিকে চলে গেছে। মনে হয় খুলনার দিকে গেছে ওরা।

ঝিকরগাছা ব্রীজ jhikargacha bridge


ওয়ারলেসের মাধ্যমে একজন ভারতীয় সৈনিক বার্তা পাঠালেন, দুশমন ভেগে গিয়েছে। ঝিকরগাছা মুক্ত। ওরা বললো, কাটাখালের ওখানে ছোট যে ব্রীজটা আছে, ওখানে আমাদের কয়েকটি ট্যাঙ্ক আছে। ব্রীজটা সঙ্কীর্ণ থাকার কারণে এপারে ঢুকতে পারছে না। এদিকে কপোতাক্ষের ব্রীজটা ভাঙা। আপনারা যে কোনোভাবে হোক, পারাপারের জন্য নৌকা জোগাড় করে দেন।

আমরা নদীর তীরে নৌকা খোঁজ করতে লাগলাম। কোথাও কোনো নৌকা নেই। কে একজন খবর দিলো, এই অঞ্চলের যত নৌকা ছিল, তা হানাদার বাহিনী একত্রিত করে মোহিনীকাটির পাশে কপোতাক্ষ নদে ডুবিয়ে রেখে গেছে।

অস্থায়ী পন্টুন সেতু তৈরির জন্য মিত্রবাহিনীর সাথে কাজ করছে সাধারণ মানুষ

কয়েকজন লোককে সেই নৌকাগুলো আনার জন্যে পাঠালাম। সন্ধ্যার পরপরই ভারতীয় বাহিনী থানার মোড়ে এসে অবস্থান নিলো। এক ঘণ্টার মধ্যে ডুবিয়ে দেওয়া বেশ কয়েকটি নৌকা এনে ওপারে নিয়ে গেলাম। আমাদের এই সাহায্য ও সহযোগিতার জন্যে একজন ভারতীয় লে. কর্নেল ধন্যবাদ জানালেন। ভাঙা ব্রীজের দক্ষিণ পাশে ব্রীজের পশ্চিম দিকে ওরা একটা পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে। ইংরেজিতে মোটা মোটা অক্ষরে — BIJOY BRIDGE লেখা। একটা কাঠের ফলকে অক্ষর গুলো জ্বল জ্বল করছে।

আমরা আনন্দে জয় বাংলা ধ্বনি দিলাম। লে. কর্নেল খুশি হলেন। তিনি আনন্দে আমায় করমর্দন করলেন। হেসে বললেন, প্লিজ, এর সঙ্গে আর একটি জয় ধ্বনি করেন—'জয় বাংলা, জয় হিন্দ।' আমরা সকলে আবার জোরে জয়ধ্বনি দিলাম । ঝিকরগাছা মুক্ত হয়ে গেল ।

সেই সঙ্গে আরো একটি বার্তা পেলাম। ৬ই ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন বাংলাদেশ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। আবারও আমরা উচ্চস্বরে জয়ধ্বনি দিলাম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

ট্যাগ সমূহ

ঝিকরগাছার ইতিহাস, ঝিকরগাছা উপজেলার ইউনিয়ন, ঝিকরগাছা খবর, গদখালি ঝিকরগাছা, ঝিকরগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান, ঝিকরগাছা পোস্ট কোড, ঝিকরগাছা এমপি, ঝিকরগাছা আবহাওয়া, ঝিকরগাছা উপজেলা ম্যাপ, ঝিকগাছার ঐতিহ্য, পানিসারা, ঝিকরগাছা পৌরসভা, ঝিকরগাছা দর্শনীয় স্থান, ঝিকরগাছা বাজার।