৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ - উৎসবমুখর ও আবেগপূর্ণ ঝিকরগাছা

সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সাংবাদিক। দীর্ঘ ৬০ বছর সাংবাদিকতা জীবনে কাজ করেছেন আনন্দবাজার, লোকসেবক, জনসেবক, যুগান্তর পত্রিকায়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার আছে অসংখ্য লেখা, বই এবং রিপোর্ট। ১৯৭১ সালে যুগান্তর পত্রিকায় কর্মরত থাকাকালীন মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের জন্য একাধিকবার এসেছিলেন যশোরে। ০৬ যশোর শত্রুমুক্ত হবার পর ০৯ ডিসেম্বর তারিখে তিনি যশোরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে যুগান্তর পত্রিকায় 'প্রায় অক্ষত অবস্থায় যশোর দূর্গ দখল' শিরোনামে একটা রিপোর্ট লেখেন। লেখাটির একটি অংশজুড়ে ছিল ঝিকরগাছা বাজারের আনন্দমুখর ও আবেগপূর্ণ মূহুর্তের বর্ণনা। 'মুক্তির উচ্ছ্বাস : ঝিকরগাছা দিবস ২০২২' উপ‌লক্ষ্যে লেখাটির ঝিকরগাছা সম্পর্কিত অংশটুকু প্রকাশিত হলো। 


বেলা সাড়ে ৯টার দিকে যখন ঝিকরগাছা পৌঁছায়, তখন সেখানে কয়েক হাজার লোকের ভীড়। ঝিকরগাছায় কপোতাক্ষ নদের উপর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ব্রিজ ও রেল ব্রিজ সোমবার রাত্র বেলা ১টা নাগাদ পাকিস্তানি সৈন্য ভেঙ্গে দিয়ে চলে গেছে। ভারতীয় বাহিনীর আজ সকাল থেকে সেখানে রাবারের নৌকার উপর দিয়ে ব্রিজ নির্মাণের কাজ আরম্ভ করেন এবং স্থানীয় লোকেরা ও মুক্তিবাহিনী ওই কাজে সহায়তা করছেন।

নৌকায় কপোতাক্ষ পার হয়ে ঝিকরগাছার পূর্ব পারে গিয়ে উঠবার পরও সেখানে আবার জনতার জয়ধ্বনি। হোটেল ওয়ালা বুড়ো নুরু মিয়া দেখেই আনন্দে কলরব করে বলে উঠলেন, বাবু আবার এসেছেন। এপ্রিল মাসের প্রথম এক সপ্তাহ ঝিকরগাছায় নুরু মিয়ার হোটেলে সাংবাদিকদের খাবার জায়গা ছিল। নুরু মিয়া চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, খানেরা খুব মেরে মরে গেছি মনে করে ফেলে দিয়েছিল। আগের হোটেল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। স্কুটারওয়ালা সহিদুল ইসলাম তার স্কুটার গাড়িতে দুইজন জওয়ান নিয়ে যাচ্ছিল। দেখা মাত্র স্কুটার থেকে এনে এসে জড়িয়ে ধরল, বাবু বেঁচে আছি। এই সহিদুল আন্দোলনের সময় আমাদের স্কুটারে করে বেনাপোল থেকে ঝিকরগাছা নিয়ে আসত। ঝিকরগাছার লোকেরা পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতনের কথা জানাতে গিয়ে বলছিল, ওদের নৃশংসতার কাহিনী বলতে গেলে এক মাসেও শেষ হবে না।

তারা বলেছিল যে, আজ যে এতো লোক দেখছেন এরা এত দিন সকলে দূর গ্রামের মধ্যে কোন রকম প্রাণ রক্ষা করেছে। বাজারে গঞ্জে কোন বয়সের পুরুষ আসতে পারত না। এতোদিন পরে মুক্তির আনন্দে তারা এসে ঝিকরগাছায় ভীড় করছে। এদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে দেখছিলাম দলে দলে লোকেরা গ্রাম পথ দিয়ে মাঠ ভেঙ্গে বাকসো প্যাটরা, কাঁথা লেপ নিয়ে ফিরে আসছে ঝিকরগাছায়। ছোট শিশুরা আসছে কেউ গরু ছাগলের দড়ি ধরে, কেউবা মুরগীকে বুকে জড়িয়ে ধরে। খালি গায়ে সকালের রোদ গায়ে মেখে হাসতে হাসতে শিশু গুলি ধ্বনি তুলছে 'জয়বাংলা'। যে মেয়েরা পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের দেখে ঊর্ধশ্বাসে দৌড়ে মান ও বাঁচাতেন তারা কাঁখে ও সংসারের জিনিস নিয়ে ভারতীয় জওয়ানদের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছেন। এ এক অদ্ভুত নিরাপত্তা বোধ ও নিশ্চয়তার আশ্বাস, যা না দেখলে বোঝা যায় না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

ট্যাগ সমূহ

ঝিকরগাছার ইতিহাস, ঝিকরগাছা উপজেলার ইউনিয়ন, ঝিকরগাছা খবর, গদখালি ঝিকরগাছা, ঝিকরগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান, ঝিকরগাছা পোস্ট কোড, ঝিকরগাছা এমপি, ঝিকরগাছা আবহাওয়া, ঝিকরগাছা উপজেলা ম্যাপ, ঝিকগাছার ঐতিহ্য, পানিসারা, ঝিকরগাছা পৌরসভা, ঝিকরগাছা দর্শনীয় স্থান, ঝিকরগাছা বাজার।