যশোর জেলার লোকজীবনের মানস ভূবন এবং তার স্বরূপ ও সত্তার প্রকৃত পরিচয় রয়েছে তার লোকভাষা ও লোক সংস্কৃতির মধ্যে। আধুনিক জীবন ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কারণে সেই লোকভাষা ও সংস্কৃতি ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
অতীতে যশোর অঞ্চল ছিল স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও যেমন ছিল আলাদা একটা রূপ- তেমনি তার লোকভাষা ও সংস্কৃতিতেও ছিল নিজস্ব একটা স্বতন্ত্রতা। উচ্চারণের 'ধ্বনি রূপের' মধ্যেও ছিল আরও - একটা রসময় মাধুর্য।
যশোর জেলায় চার ধরণের মৌখিক ভাষা বিশেষভাবে লক্ষ্যগোচর হয়। অশিক্ষিত নিরক্ষর চাষা-ভূষা, তাঁতী, কুমার, কামার অর্থাৎ খেটে খাওয়া মানুষেরা যে বাক্য ভাবপ্রকাশের জন্য উচ্চারণ করে, তার মধ্যে রয়েছে সহজ সরল একটা গ্রাম্য স্বভাব বা প্রবণতা। এই প্রবণতাকে শিক্ষিতজনেরা মূর্খতা বলে কটাক্ষ করেন। প্রকৃতপক্ষে বলা যায় যে, এটা কোন ক্রমেই মূর্খতা নয় এটা হচ্ছে আদিম সারল্য। উচ্চারণের ক্ষেত্রে সবমুলুকেই কিছুটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন উদাহরণ হিসাবে বলা যায়- 'র' শব্দের উচ্চারণ। 'র' এর পরিবর্তে যশোর অঞ্চলে অশিক্ষিত জনগণ 'অ' উচ্চারণ করে থাকে। আবার কেউ কেউ 'ন' উচ্চারণ করেন। যথা :
রান্না > আন্না বা নান্না
রোদ > নোদ
রক্ত > নক্ত
রয়েছে > নয়েছে
রসুন > নসুন
রাজহাঁস > নাজহাঁস
রাত > নাত
রোববার > নোববার
রহমান > নহমান
রাজ্জাক > নাজ্জাক
রাক্ষস > নাক্ষস
রসগোল্লা > নসগোল্লা
ক্রিয়া পদের রূপ ও ধ্বনিতে পরিবর্তন ও দেখা যায় । যথা :
করছে > কত্তিছে বা কত্তেছে বা কত্তিলো ।
যেতে > যাতি ।
খেতে > খাতি ।
দিলো > দেলো বা দিলি ।
বলতে > বলতি ।
পাবে > পাবেনে বা পাবানে ।
চলতে > চলিতে ।
যাবো > যাবানে ।
হতে > হতি ।
কইবে > করানে ।
যাসনে > যেসেনে ।
চাইছে > চেতেছে ।
সংযুক্ত ব্যঞ্জন শব্দের আদিতে সেটাকে ভেঙে সরলী করার ঝোঁকও দেখা যায়। যথা :
জ্ঞান > গেয়ান ।
গ্রাম > গেরাম ।
ক্ষতি > খেতি
ক্রমে ক্রমে > কেরমে কেরমে।
স্রোত > ছুরোত।
স্নান > ছেনান বা ছ্যান ।
ম্লান > মিলান ।
গ্রাস < গেরাস ।
যন্ত্র > যনতর ।
কারক বিভক্তির ক্ষেত্রেও 'কে' এর জায়গায় 'রে' এর প্রচলন । যথা:
আমাকে > আমারে ।
তোমাকে > তোমারে ।
গাজিকে > গাজিরে।
মাকে > মারে ।
ভাইকে > ভাইরে ।
করণ কারকের ক্ষেত্রেও দেখা যায় একই রকম ব্যাহার বিধি । যথা:
দিয়ে > দে।
নিয়ে < নে । আবার 'দ' এর স্থলে 'গ' এর ব্যবহার হয় ।
আমাদের > আমাগের ।
তোমাদের > তোমাগের ।
এছাড়াও কোন কোন স্থানে মিশ্রভাষারও সংযোগ ঘটেছে। গ্রাম্য একটি ছড়ায় আছে -
লক্ষণ পালের ঢ্যাবা ছাওয়াল
পিরিত কত্তেছে
নাঙা জামার বুক পগেড়ে
নুমাল নেকেছে
ওই নুমালের মদ্যি আছে
সেই ছেমড়ির ফটোক
বুদ্দি করে এখনই গে
পাটাই দেরে ঘটক।
তা না হলি মারকেটে গে
আনবে কিনে বিষ
গুখেগোর ঐ মরা লাশটা লে-
মরগে তোলবে পুলিশ।
(খ) উঠোন ক্লিয়ার -
গাছে ফ্লাওয়ার
ডোন্ট কেয়ার
আই প্লেয়ার
লাম্বা হেয়ার
ঘরে দাও ফায়ার
ছাহেব ছেলাম
ইওর গোলাম।
(গ) আগ্ ধুম্সি-
বাগ্ ধুম্সি বাবুর ব্যাডা লো
ছেনাল মাগির
কোচ্ছে শুয়ে পেরেম কত্তিলো
গা টেপলো
পা টেপলো গলায় দেলো হাত
ছেনাল মাগির জড়ায় ধরে কাটায় দেলো নাত।
আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এই ধরনের লোকগান, ছড়াগান, এবং লোক প্রবাদ যশোর অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে এখনো ছড়িয়ে রয়েছে । আবার বিভিন্ন জেলার লোক এই জেলায় বসতি করার ফলে মিশ্রভাষা ব্যবহার হচ্ছে । অনেক ক্ষেত্রে লোকভাষার ধ্বনি ও রূপগত বৈশিষ্ট্য বদলেও গিয়েছে ।
বর্তমান সমগ্র অঞ্চলে প্রচলিত যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য বজায় রয়েছে তা মোটামুটি নিম্নরূপ :
অ > আ : লাম্বা বা নম্বা। লাম্বা লাম্বা দাড়ি । অকাট > আকাট । লোকটা আকাট মূর্খ । নষ্ট > নাষ্ট : ব্যাটা নাষ্টের গোঁড়া।
অ > উঃ অলক্ষণে > অলুক্ষণে । সামনে > সুমুক > একটু সয়ক চল, মন্দির> মুন্দির মুন্দিরে ঘন্টা বাজছে ।
অ > এ : প্রচ্ছব > পেচ্ছাব । প্রজা > পেরজা। আমরা রাজার পেরজা।
ই > এ : নিত্য > নেত্য। নিঃসঙ্গ > নেসঙ্গ । লিখন > লেখন, ইত্যাদি
> এত্যাদি, জীবন > জেবন।
ইয়া > অ্যা : সিনান > চ্যান । শিয়াল < শেয়াল । বিহান > ব্যান । ব্যান বেলায় হাঁটতে হাঁটতে মাঠে গিয়েছিলাম।
ঋ > ই / এ : সৃষ্টি > ছিষ্টি । কৃষ্টি > কিষ্টি বৃষ্টি > বিষ্টি মূষল ধারে বিষ্টি পড়ছে।
গৃহস্থ > গেরেস্থ । অদৃষ্ট > অদেষ্ট।
এ / আঃ যেতে > যাতি । খেতে > খাতি ।
অন্ত্যএ > ই : এবার > ইবার । এখানে > ইকানে । এটা > ইটা । বলতে
< বলতি । করতে < কত্তি। মধ্যে > মদ্যি। দিলে > দিলি । মুখে > মুকি । মুকি মুকি কথা বলবি না লো ।
এ > এ্যা > য়্যা > অ্যা : মিয়া ভাই > ম্যা বাই, খেলা > খ্যালা, ঠেলা > ঠ্যালা, তেলা > ত্যালা, বেলা < ব্যালা, মেলা > ম্যালা, একটা > এ্যাকটা / য়্যাকটা / অ্যাকটা । একা > এ্যাকা । বেঁকা > ব্যাঁকা। বেড়া > ব্যাড়া কেনা >ক্যান। মেঘ > ম্যাঘ আল্লাহ ম্যাঘ দে পানি দে ।
ও /উঃ শোন > শুন । কোন > কুন । বোন > বুন ।
ঐ > ও : বৈশাখ > বোশেখ। জ্যৈষ্ঠ > জোষ্ঠি । পৈঠা > পোঠে। খৈল > খোল ।
ঔ > ও : ঔষুধ > ওষুধ ।
ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণও পরিবর্তন লক্ষণীয়
ক > গ : শোক > শোগ। লোক > লোগ । সকল > সগল । বক >
বগ । কাক > কাগ কাগা করে কা কা- দুপুর ব্যাল খা খা । শাক > শাগ। ক > উঃ ঠাকুর > ঠাউর । কুকুর > কুইর । কুঁকড়ো > কুগুড়ো ।
খ > ক : চোখ > চোক চোক গেল, চোক গেল, ডাকছে রাতে পাখি ! ছ > ত : করছি > কত্তিছি বলছিলাম > বলতিলাম ।
ঝ > জ : সাঁঝের বেলা > সাজের বেলা । বুঝে > বুজে।
ট / ঠ > ড : ব্যাটা > ব্যাডা । শরীরটা > শরীরডা। বেলাটা > বেলাডা।
ঠ > ট : উঠোন > উটোন ।
ন > ল : নম্বর > লম্বর । নৌকা > লৌকা। নাঙল > লাঙল । নেপা > লেপা । নেবু > লেবু । নাউ > লাউ । নুঙ্গি > লুঙ্গি
র > নঃ রেলগাড়ি > নেলগাড়ি । রিকশা > নিকশা। রঙিলা > নঙিলা ।
রয়েছে > নয়েছে । ল > নঃ লজ্জা > নজ্জা । লক্ষণ > নক্ষণ । লক্ষ্মী > নক্ষ্মী, লুচি > নুচি ।
লুকানো > নুকানো। লবাব > নবাব। লোহা > নোহা । লবঙ্গ > নবঙ্গ ।
লাগতেছে > নাগতেছে । নাচতেছে > লাচতেছে । স/শ> ছ/চ/হ : সামিয়ানা > ছামিয়ানা। সোর > শোর, আপশোস >
আপছোচ । সেপাই > ছেপাই। আসমান > আছমান। পশ্চিম > পশ্চিম । সেখানে > সেহানে। যশোর অঞ্চলে লোকভাষার শব্দভাণ্ডার এমন এমন শব্দ আছে যে- যা একান্তই এ জেলার নিজস্ব। উচ্চারণের মধ্যেও রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য ।
উদাহরণ হিসাবে কয়েকটি শব্দের নুমনা এখানে তুলে ধরছি :
(১) প্যাটেলি > পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, (২) খাবুর > নোংরা, (৩) হিন্দার < এই হেন (৪) কিন্দার > কেমন, (৫) নুড়োয় > দৌড়োয়, (৬) জুতে > জুড়ে দেওয়া, (৭) টেমক > রাগ, (৮) ভেয়েনি > ভাইয়ের স্ত্রী, (৯) কুদাকুদি > ছোট ছেলেমেয়ে, (১০) হ্যারো-ব্যারো > যাদের জন্মের ঠিক ঠিকানা নেই, (১১) হোল্ডুব > পানির তলে ডুবে থাকা, (১২) খেরো > মাছ রাখার পাত্র (বাঁশের চটি দিয়ে তৈরি করা), (১৩) পয়েন > গরুর গাড়ির চাকায় তৈরি পথ, (১৪) চড়মাতালে > হঠাৎ রাগান্বিত হয়ে চড় মারার জন্য মাতাল হওয়া, (১৫) হচ্যে > হচ্ছে, (১৬) ন্যাকামো > রসিকতা।
একদা যশোর অঞ্চলে সম্বোধনসূচক দুটি শব্দ বহুল প্রচলিত ছিল । শব্দ দুটি হলো-'হ্যাগো' এবং 'ওলো'। বর্তমানে শব্দ দুটি প্রায় লোপ হওয়ার পথে । প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে এখনো কেউ কেউ পরস্পর সম্বোধন করে শব্দ দুটি উচ্চারণ করে । পুরুষরা বলে-'হ্যাগো', মহিলারা বলে-'ওলো'।
বাংলা সাহিত্যে যশোরের আঞ্চলিক ভাষার প্রথম সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি তার 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’ নাটকে পুরোপুরি যশোরের কথ্যভাষাকে ব্যবহার করেছেন :
“হানি। কত্তাবাবু, সালাম করি।
ভক্ত । (অতি ব্যাকুলভাবে) এ কি! অ্যা! এ আবার কি সর্বনাশ উপস্থিত?
হানি । (হাস্যমুখে) কত্তাবাবু, আমি ঘরে আস্যে ফতিরি তল্লাস কল্লাম, তা সকলে কলে যে সে এই ভাঙ্গা মন্দিরির দিকে পুঁটির সাথে আয়েছে, তাই তারে চুড়তি আস্যে পড়িছি। আপনার যে মোছলমান হতি সাধ গেছে তা জানতি পাল্লি ভাবনা কি ছিল? ফতি, তো চায়েও সোনার চাঁদ আপনারে আন্যে দিতি পাত্তাম, তা এর জন্যি আপনি তজতি নেলেন কেন? তোবা! তোবা!
ভক্ত । (চিন্তা করিয়া নম্রভাবে) বাবা হানিফ, আমি সব বুঝেছি, তা আমি যেমন তোমার উপর অহেতুক অত্যাচার করেছিলাম, তেমনি তার বিধিমত শাস্তিও পেয়েছি, আর কেন? এখন ক্ষান্ত দাও! আমি বরঞ্চ তোমাকে কিছু দিতেও রাজি আছি কিন্তু বাপু একথা যেন আর প্রকাশ না হয়, এই ভিক্ষাটি আমি চাই । হে বাবা, তোর হাত ধরি!
হানি। সেকি কত্তাবাবু? আপনি যে নাড়েদের এত গাল পাড়তেন, এখন আপনি খোদ নাড়ো হতে বসেছেন, এর চেয়ে খুশির কথা আর কি হতে পারে? তা একথা তো আমার জাত কুটুমগো কতিই হবে
ভক্ত । সর্বনাশ! -বলিস কি হানিফ ?...
বান্ত (ঈষৎ হাস্যমুখে) ও হানিফ, একবার এদিকে আয় দেখি...
ভক্ত । রাধে-রাধে- এমন বিভ্রাটে মানুষ পড়ে!...
ফতে । (অগ্রসর হইয়া সহাস্য বদনে) কেন কত্তাবাবু? নাড়ের মায়্যে কি
এখন আর পছন্দ হচ্ছে না?
ভক্ত । দূর হ, হতভাগি....
ফতে । সে কি কত্তাবাবু? এই মুই আপনার কলজে হচ্ছিলাম, আরো কি কি হচ্ছিলাম; আবার এখন মোরে দূর কত্তি চাও।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের এই নাটকের হানিফ এবং ফাতেমার চরিত্রের কথোপকোথনের মধ্যেই রয়েছে খাঁটি যশোর অঞ্চলের কথ্যভাষা । তিনি এমন ভাবে সংলাপ তৈরি করেছেন যে, এখানকার লোকদের কি রকম বাকভঙ্গিমা এবং কি রকম উচ্চারণ ধ্বনি, তা মূর্ত হয়ে উঠেছে। ‘আস্যে ফতিরি তল্লাস কল্লাম’, ‘সকলে কলে’, ‘মন্দিরে’, ‘আয়েছে’, চুঁড়তি ছুঁড়তি আস্যে পড়িছি', ‘জানতি পাল্লি’, ‘ওর চায়েও’, ‘আন্যে দিতি পাত্তাম', 'নাড়ের মায়্যে', 'কলজে হচ্ছেলাম', ‘দূর কত্তি চাও' ইত্যাদি শব্দ আজও গ্রাম সমাজে অবিকল টিকে রয়েছে।
লেখক : হোসেনউদ্দীন হোসেন
মূল প্রবন্ধ : যশোর জেলার লোকভাষা ও লোকসংস্কৃতি